গত সোমবার রাত ১০টায় কানাইঘাটের কান্দলা নয়াবাজারে জল্লাদ ফারুক হোসেনের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
এ সময় তিনি আবেগ আপ্লুত ভাবে বলেন, এলাকার দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, জুলুম-অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সমাজের কিছু অতি উৎসাহি লোকজনের রোষানলে পড়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিভিন্ন মামলায় তিনি প্রথমে ১৯৮৪ সালে আটক হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আবার ১৯৮৯ সালে আবার আটক হলে আদালত থাকে ৮৬ বছর ৯ মাসের সাজা প্রদান করেন। তিনি দুই ধাপে সর্বমোট ৩৫ বছর সাজা ভোগ করার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে খালাস প্রাপ্ত হয়ে বাড়ী এসে এখন বড় অসহায়। জেলে যাওয়ার সময় তিনি ছিলেন ২৯ বছর বয়সের এক বীর সাহসী প্রতিবাদি যুবক। সে সময় তিনি ছিলেন বিবাহিত এবং ১ ছেলে, ১ মেয়ের জনক।
জল্লাদ ফারুক বলেন, ১৯৮৩ সালের দিকে এলাকার সমাজ পরিচালনায় একটি মহলের অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একের পর এক মামলার আসামী হওয়ার পর নানা পরিস্থিতির শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। সেখানেও প্রায় ১৯ বছর নানা অপরাধের মধ্যে নিরব থেকেছিলেন তিনি। এরপর নানা অপরাধ সহ্য করতে না পেরে তিনি জেলের বিতরে নানা অনিয়ম ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন কারণে সিলেট কারাগার থেকে কাশেমপুর কারাগার, কাশেমপুর থেকে কুমিল্লা কারাগার। আবার কুমিল্লা থেকে সিলেট কারাগারে জেল খেটেছেন।
পরবর্তীতে কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ২০০৮ সালের দিকে প্রথমে সহযোগী জল্লাদ এবং ২০১২ সালের দিকে প্রধান জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় তার হাতে জঙ্গি রিপন সহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিলো বলে জানান তিনি। যে কারণে তিনি জেলের ভিতরে থেকেও ছিলেন সবার কাছে আলোচিত সমালোচিত।
জল্লাদ ফারুক বলেন, জেলে যাওয়ার পুর্বে তিনি ছিলেন এলাকার সৎ সাহসী একজন প্রতিবাদি যুবক। তার সামনে এলাকার নিরীহ-অসহায়, নির্যাতিত কোন মানুষের উপর অন্যায়-অবিচার দেখলেই তিনি নিরীহ নির্যাতিত মানুষের পক্ষে থেকে প্রতিবাদ করতেন। সে কারণে তিনি পড়েছিলেন অনেকের রোষানলে। যে কারণে জেলের বিতরে এবং বাইরে থাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। যাহা অন্য কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নহে।
জেলের বিতরে এলাকার কোন মানুষ গেলেই তাকে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি। যে কাজটি তিনি বিগত ৩৫ বছর জেলের বিতরে করেছেন। এ ছাড়া ফারুক বলেন, তিনি জেলের বিতরে অন্যান্য জল্লাদ থেকে ছিলেন ভিন্ন। কারণ তিনি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পরও তাহজুদ নামাজ আদায় করতেন। গত ১২ বছরের মধ্যে তার কোন ফরজ নামাজ কাজা কিংবা মিস হয়নি। হয়তো কোন কারণে ২/৪দিন তাহজুদ নামাজ মিস হতে পারে বলে জানান তিনি।
জল্লাদ ফারুক বলেন, এক সময় তার পিতা-মাতা সহ সবাই ছিলো। তিনি ছিলেন সবার আদরের ছোট ছেলে। আজ ৩৫ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে বাড়িতে এসে দেখেন তিনি সবার বড়। পরিবারের দাদা হয়েছেন। এখন তার পরিবার পরিচালনায় অনেক কিছু করার সাধ থাকলেও সাধ্য যে তার একেবারে নেই। সে কারণে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করছেন।
তিনি এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে আবেগ আপ্লুত ভাবে বলেন, তার বাবা কৃষি কাজ করতেন। পাশাপাশি পরিবার পরিচালনায় তাদের সবই ছিলো। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে বাড়িতে এসে একটি কুড়ে ঘর ছাড়া এখন আর কিছুই পাননি তিনি। তাকে জেল থেকে বের করে আনতে তার পিতা সবই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন, এলাকার মানুষের দোয়া ও সহযোগীতায় তার পরিবার বর্তমানে চলছে।
কানাইঘাটের জল্লাদ ফারুকের সাথে এ প্রসঙ্গে আলাপকালে উপস্থিত ছিলেন সিলেট জেলা পরিষদের ১৫নং ওয়ার্ডের সদস্য আলহাজ্ব আলমাছ উদ্দিন, লক্ষীপ্রসাদ পুর্ব ইউনিয়ন বিএনপির আহবায়ক ফখর উদ্দিন চৌধুরী, লক্ষীপ্রসাদ পুর্ব ইউপি জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিলাল আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড নেতা আব্দুর রহমান জীবন প্রমূখ।
তারা বলেন, আমাদের এলাকার বীর পুরুষ ফারুক হোসেন জেল থেকে বের হয়ে এখন বড় অসহায় জীবন যাপন করছেন। এ অবস্থায় আমরা এলাকাবাসী তার বাড়ীতে একটি পাকাঘর নির্মাণ সহ তার পরিবারের ভরনপোষনের জন্য আর্থিক সহযোগীতা প্রদান করছি। তারা জল্লাদ ফারুক হোসেনের জন্য সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।