রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কিছু জরুরী পরামর্শ
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ এপ্রিল ২০১৯, ৮:৪৯ অপরাহ্ণ।। ডাঃ এম এ ছালাম।।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যারা ডায়াবেটিসের ঔষধ সেবন করেন অথবা ইনসুলিন নেন তারা রমজানের সময় সে সব ঔষধের ধরন/ডোজ পরিবর্তন করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারন একই ডোজে রমজানে ঔষধ/ইনসুলিন নিলে সুগার কমে গিয়ে মারাত্মক বিপদ হতে পারে।
যাকে বলে hypoglycemic coma. সারাদিন উপবাসের পর বিকাল ৩/৪টার দিগে সেটা হতে পারে। তাই সকলের বিশেষ করে ইনসুলিন গ্রহীতাদের হাতের কাছে (glucometer) ঘরে বসে সুগার মাপার মিশিন রাখা দরকার এবং বিকালের দিগে কোন ডায়াবেটিস রোগীর মাথা জিম জিম, বমির ভাব, অস্থিরতা অথবা ঘাম জড়ালে, খুব বেশী হার্টে ধরপর বা মুখ শোকালে সুগার মেপে দেখতে হবে এবং ৩.৫ মিলিমোল (৬০ মিলিগ্রাম)/ নীচে পাওয়া গেলে রোজা ভাংতে হবে এবং সাথে সাথে এক গ্লাস পানিতে ২-৩ চা চামচ চিনি গুলিয়ে খাওয়াতে হবে, ফলমুল/ভাত খেতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে সুগার ৩ মিলিমোল (৫৫মিলিগ্রাম)/ নীচে গেলে রোগী বেহুঁশ হয়ে যাবে কারন মস্তিষ্কে গ্লুকোজ কমে গেলে এবং এ অবস্থা ৪ ঘন্টার বেশী স্থায়ী হলে রোগী বাঁচা খুবই মুশকিল।
সুতরাং সকলের এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।আবার রক্তে খুব বেশী গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া যেমন ১৬/১৭ মিলিমোল(৩০০ মিলিগ্রাম)/তার বেশী হয়ে গেলেও বিপদ আছে,কারন তাতে কিটোন বডি তৈরী হয়ে ketoacidosis হয়ে মারাত্মক dehydration দেখা দিতে পারে অথবা hyperglycemic coma হতে পারে সেজন্য ও রোজা ভাংতে হবে।
যাদের ডায়াবেটিস খুব বেশী উটানামা করে এবং hypoglycemic coma/hypergycemic coma অতীতে হয়ে থাকার ইতিহাস আছে এবং হওয়ার প্রবণতা থাকে বিশেষ করে কিডনী/লিভারের রোগী তাদের রোজা না রাখাই উত্তম।রমজানে ঔষধ কমানোর ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো metformin/Gliptin জাতীয় ঔষধের ডোজ কমানো লাগবে না, তবে যারা glipizide/Gliclazide/glimepride(secrin) জাতীয় ঔষধ খাচ্ছেন তাদের সেগুলি এক তৃতীয়াংশ ডোজ কমাতে হবে এবং সেগুলি কেবল সন্ধাবেলা খাওয়া উচিত।
অন্যান্য ঔষধের বেলায় সকালের ঔষধ রমজানে সন্ধ্যায় এবং রাত্রের ঔষধ সেহরীর সময় খেতে হবে। যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন তাদের ৩ ডোজের (রেগুলার ইনসুলিন ) ২ ডোজ সন্ধায় (ইফতারে সাথে সাথে) ও সেহরীর সময় নিতে হবে এবং মোট ডোজের এক তৃতীয়াংশ ডোজ কমাতে হবে এবং সেটা সেহরীর সময় কমানো বান্ছনীয়। যারা ২৪ ঘন্টা কার্যকর ইনসুলিন (যেমন লেন্টাস) রাত্রের বেলায় নিয়ে থাকেন তারা সেটার ডোজ এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে তেরাবীর পর খাবারের সময় নিতে হবে।
রমজানের ডায়াবেটিস রোগীর খাওয়া দাওয়াঃ
মোট ক্যালরি গ্রহনের পরিমান আগের মতো একই থাকবে। খাওয়ার পরিমান ২-৩ ভাগ করতে হবে, যেমন ইফতার, রাতের খাওয়া এবং সেহেরী।অনেকে কেবল ইফতার ও সেহরীর খান এটা ঠিক নয়।তারাবির পর ও কিছু খাওয়া উচিত।
ইফতারের সময় মিষ্টি জাতীয় খাবার,ভাজা-পোঁড়া কম খাওয়া উত্তম। পানি বেশী পরিমানে পান করবেন।গরমের দিনে কচি ডাবের পানি সবচেয়ে উপকারী। চিনির প্রয়োজন হলে, চিনির বিকল্প আর্টিফিশিয়াল সুইটনার ব্যাবহার করা যাব( জিরোকেল / )।
ইফতার ও সেহেরিতে অন্য খাবারের সাথে সবজি, ফল খাওয়া ভাল। সেহেরির শেষ সময়ে সেহেরী খাওয়া উত্তম।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়ামঃ
দিনেরবেলা ব্যায়াম করা উচিত না। ইফতারের এক ঘণ্টা বা তারাবির পর ব্যায়াম করা যেতে পারে ।
তারাবির নামাজেও রোগীর অনেকটা ব্যায়াম হয়ে যায়, তাই রমজানে ব্যায়াম করতে না পারলে তেমন অসুবিধা নাই।
রমজানের ঠিক আগে ও পরে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ সময় করে নেওয়া সকলের একান্ত প্রয়োজন।
রোজা মাসে দিনের বেলা ইনজেকশন ও ডায়াবেটিস মাপার ব্যাপারে অনেকের ভ্রান্ত ধারনা আছে যে ইহাতে রোজা নষ্ট হবে।আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই ইনজেকশন বা রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হয়না। কেবল সেলাইন/শক্তির কোন ইনজেকশন দিলে রোজা নষ্ট হবে। তাই প্রয়োজন হলে দিনের বেলায় ইনজেকশন অথবা রক্ত পরীক্ষা রোজা রেখে করাতে পারেন তাতে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন লাগলে ৩ বারই দিতে হয় তাই রোজা না রাখাই উত্তম কারন এই সময় গর্ভের সন্তানের জন্য ব্লাড সুগার ৫.৫ থেকে৬.৫ মিলিমোলের মধ্যে রাখতেই হবে। কোন অবস্থায় তার উপরে ও নীচে যেতে দেওয়া যাবে না এবং রোজা রেখে সেটা সম্ভব নহে তাই রোজা না রেখে পরবর্তীতে রাখাই উত্তম। মাতৃদুগ্ধ সেবনকারী ডায়াবেটিস রোগী রোজা না রাখাই উত্তম।
সবশেষে glucometer এর ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।অনেকেই সেগুলি বিদেশ থেকে পেয়ে থাকেন কেউ কেউ ৭০০-১০০০ টাকায় কিনেন। মনে রাখতে হবে নির্ভুল রিপোর্ট টা আমাদের দরকার । বিদেশের গুলি ভাল হলে ও স্ট্রিপ পাওয়া মুশকিল আর কম দামী গুলির রিপোর্ট সঠিক হয় না। তাই ২০০০-২৫০০ টাকা দামের গুলি কিনতে হবে। মনে রাখতে হবে এগুলি ঘরে বসে মনিটারিং এর জন্য এই রিপোর্ট কে ফাইনাল বলা যাবে না তাই প্রত্যেকবার স্ট্রিপ কিনার পর মেশিনটি standardize করতে হবে অর্থাত কোন নির্ভরযোগ্য পরীক্ষাগারে রক্ত পরীক্ষা করে এবং নিজের মেশিনে পরীক্ষা করে মিলিয়ে নিতে হবে। মনে রাখবেন glucometerএর ফলাফল ৫-১০% বেশী হতে হবে তখনই বোঝা যাবে মেশিনটি সঠিক। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন,হাঁটাহাটি করুন ,পরিমিত সুষম খাবার গ্রহন ও ডাক্তারের পরামর্শাঅনুযায়ী ঔষধ ব্যবহার করুন। রমজানে রোজা রেখে সুস্থ থাকা ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ গ্রহন করুন।
লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ডায়াবেটোলজিষ্ট।অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।