সবার কাছ থেকে শিখুন ।। তন্ময় ভট্টাচার্য।।

বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৩২ পূর্বাহ্ণতন্ময় ভট্টাচার্য
প্রায় সব কোম্পানির মতো আমাদের কোম্পানিও শিক্ষাবাবদ ভালোই ঋণ দেয়। শিক্ষা ঋণ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করে কীভাবে চাকরিজীবীরা কর্মক্ষেত্রে উপকৃত হচ্ছে তা নিয়ে বড় একটি মিটিং হচ্ছিলো একটা বড় হলরুমে। প্রায় ১০০জনের মতো মানুষ। বিভিন্ন মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন তাঁরা কীভাবে উপকৃত হচ্ছেন। সভার শেষের দিকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও সভার সভাপতি সভার সমাপ্তি ঘোষণা করার আগে জানতে চাইলেন আর কেউ কারো শিক্ষার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছুক কী না। জিজ্ঞাসা করলেন কোন শিক্ষকের অবদান তুলে ধরতে ইচ্ছুক কী না। এ রকম প্রশ্নে নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে আমি হাত তুলি।
ভাইস-প্রেসিডেন্ট বললেন, “বলুন, শুনি। এটাই লাস্ট। আমাদের সময় কম থাকার জন্য আমরা সত্যিই দুঃখিত”। আমি বললাম, “ধন্যবাদ। আমি এই কোম্পানির চাকরিজীবী। আমি এখনো পর্যন্ত কোন শিক্ষা ঋণ নেইনি। আমি কি কিছু বলতে পারি”? উত্তরে তিনি বললেন, নিশ্চয়ই, বলুন। তবে যেহেতু আমাদের সময় কম, তাই সংক্ষিপ্ত করে বলুন। সেখানে যা বলছিলাম তার বাংলা অনুবাদ লিখার চেষ্টা করছি।
“সম্মানিত ভাইস-প্রেসিডেন্ট, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি জানি দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে এবং এখন ১২টা। সময় শেষ হয়ে গেছে এই সভার। কিন্তু, আমি নিজেকে থামাতে না পেরে একজন শিক্ষক সম্পর্কে ১টি কথা বলতে চাচ্ছি। আমরা কি সেই শিক্ষককে সম্মান দিয়ে ২-৩মিনিট সময় দিতে পারি? তাই, যাঁরা উঠে যাচ্ছেন, আমরা কি ২মিনিট অপেক্ষা করতে পারি?”
“আমি যে শিক্ষক সম্পর্কে বলতে চাচ্ছি তিনি কোন স্বণামধন্য স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেননি। তিনি তাঁর জীবনে কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন কী না তা জানি না। তবুও তিনি আমার শিক্ষক। আপনারা কি সেরকম কোন শিক্ষকের কথা শুননে চান? যদি না চান, তবে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ”
সবাই তখন নীরব। ভাইস-প্রেসিডেন্ট বললেন, “ইন্টারেস্টিং, গো এহেড”! আমি বললামঃ
আমার এস.এস.সি. পরীক্ষার ফলাফল বের হলো, আমি স্টার মার্কস পেলাম। আমাদের দেশে সে সময় স্টার মার্কস পাওয়া মানে অনেক ভালো রেজাল্ট করা। একটা ধারণা দিই, তখন আমাদের থানায়(থানা আমেরিকাতে একটা কাউন্টির মতো) আমরা মাত্র ৩জন স্টার মার্কস পেয়েছিলাম। এটা এমন ভালো রেজাল্ট ছিল যে, মানুষজন দেখতে আসতো কে স্টার মার্কস পেলো। দিনটা ছিল এ রকম শীতের দিন। ঐ শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, আপনি তো স্টার মার্কস পাওয়া অনেক ভালো ছাত্র, আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি”? আমি বললাম, “হ্যাঁ, করুন”। তিনি বললেন, “আপনি বড় হবার পর যখন চাকরি করবেন, তখন ধরুন সম্মাননা হিসাবে আপনাকে দুটি অপশন দেওয়া হলো। আপনি যে কোন একটা নিতে হবে। প্রশ্ন হলো আপনি কোন অপশন নেবেন। অপশনগুলো হলো
একঃ আপনার প্রতি মাসের পারিশ্রমিক ৫০হাজার টাকা।
দুইঃ আপনার ১ম দিনের বেতন একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি। ২য় দিন ২টা, তয় দিন ৪টা, ৪র্থ দিন ৮টা, ৫ম দিন ১৬টা। এভাবে প্রতিদিন দ্বিগুণ হবে কাঠির সংখ্যা।
প্রসঙ্গত বলেই রাখি, তখন আমাদের দেশে ১টাকা দিয়ে একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স পাওয়া যেত যাতে ৪০টা দিয়াশলাইয়ের কাঠি থাকতো। আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে মনে মনে হিসাব করলাম আমি দশম দিনে ১০২৪ টা দিয়াশলাইয়ের কাঠি পাব। তাই কনফিডেন্ট নিয়ে ১ম অপশন, অর্থাৎ ৫০হাজার টাকার পারিশ্রমিক পছন্দ করলাম।
তিনি আমাকে হাতে ধরে অঙ্ক করে বুঝিয়ে দিলেন আমি যদি দিয়াশলাইয়ের কাঠি পছন্দ করতাম, তবে ২৩তম দিনে আমি ৪১৯৪৩০৪টা কাঠি পেতাম যার দাম আমার প্রথম অপশনের এক মাসের বেতনের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। ১ম মাসে আমার আরও ৭দিন বাকি থাকতো যার প্রতিদিন আমি ১ম অপশনের দ্বিগুন, তিনগুণ, চারগুণ করে বেতন পেয়ে যেতাম। আমি তখন আশ্চর্য হয়ে হিসাবটা মনে মনে মেলাই এবং মেনে নিই।
পাঠ্য বইয়ে অনেক পড়েছি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকনা থেকে মহাদেশ হয়, বিন্দু বিন্দু জল থেকে মহাসাগর হয়, পড়েছি অনেক রচনা আর ভাব-সম্প্রসারণ। এ পড়াগুলো আমার ঐদিনের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়েছিল অথবা আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু আজও যখন এরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়ি, তখন ব্যর্থ হয় না আমার সেই দিনের শিক্ষা আর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমার সেই শিক্ষককে যাঁকে আমি ডাকি ‘সুকিল দা’। এটাই আমার বক্তব্য।
আমরা তখন ভাইস-প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে এই শিক্ষকের সম্মাননা স্বরুপ ১মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করি। যে বা যাঁরা সেই ‘সুকিল দা’ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাঁরা এই ঠিকানায় (সুকিল দাস, গ্রামঃ সানেশ্বর, ডাকঃ দাসউরা বাজার, থানাঃ বিয়ানীবাজার, জেলাঃ সিলেট) যোগাযোগ করতে পারেন।
এই লিখা পড়ার পর আপনি যাঁর কাছ থেকে কোন কিছু শিখতে পারছেন সবাইকে আপনার শিক্ষক বলে মনে করবেন সেই আশা রইল। আমার মতে, আমি যাঁর কাছ থেকে কোন কিছু শিখতে পারছি সবাই আমার শিক্ষক; তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাক আর না-ই থাক।
তন্ময় ভট্টাচার্য: কলামিস্ট। গর্বিত বাংলাদেশী। tonmay@lekhashare.com