তাঁরা রাজনীতির নায়ক, তবে…?
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১:৫২ অপরাহ্ণবিয়ানীবাজারবার্তা২৪.কম।।
বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন আগামী ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। এবার প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যকোন রাজনৈতিক দল তাতে অংশ নিচ্ছে না। এজন্য নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র মোড়কে আ’লীগের তিনজন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। এরমধ্যে বিগত নির্বাচনে একজন এবং অপর দু’জন এবারই প্রথম নির্বাচন করছেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নৌকা প্রতীকের আবেদন গিয়েছিল ৯জনের। এরমধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খান পুনরায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এ কারণে অনেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে নিরব; আবার মোহাম্মদ জাকির হোসেন, মো. শামীম আহমেদ এবং আবুল কাশেম পল্লব চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী জামাল হোসেন দলীয় সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে শেষ পর্যন্ত ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোর্ডে নাম ছিল অথচ নৌকার কান্ডারি হতে পারেননি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি আব্দুল হাছিব মনিয়া, উপ-দপ্তর সম্পাদক এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপির দীর্ঘ ১০ বছরের স্থানীয় উন্নয়ন দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহŸায়ক ও জেলা যুবলীগের সহ সভাপতি মো. আব্দুল বারী, চারখাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাবেক ছাত্রনেতা মাহমুদ আলী।
স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নানা বিচার বিশ্লেষণে আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত আব্দুল হাছিব মনিয়া, আব্দুল বারী ও দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল নেতাকর্মী তথা ভোটারদের কাছে নিয়ামক শক্তি কিংবা নির্দেশক হিসেবে পরিগণিত। নৌকার বিজয়ে এ তিনজনের একেকজন একেকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাঁরা মনোক্ষুন্ন, ভাবলেশহীন, নিশ্চুপ রয়েছেন; না দূরদর্শী কৌশলগত কারণে স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে নির্বাচনী মাঠ পর্যবেক্ষণ করছেন তা এ মুহূর্তে বোঝা মুশকিল।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান। তাঁর হাতে নৌকা তুলে দেওয়া হলেও নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে, তারা যেন নৌকার বিজয় নিশ্চিত করেন। এ হিসেবে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর উচিত নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া এবং সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় শরিক হতে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করা। এখনো নির্বাচন প্রচারণা জমেনি। ২৮ জানুয়ারি প্রতীক পেলেই তা পুরোদমে জমে উঠার প্রত্যাশায় রয়েছেন প্রার্থী ও দলের প্রতি অনুগত নেতাকর্মীরা।
নিরুত্তাপ, নির্জীব ভোটের মাঠে নায়কের আসনে রয়েছেন আব্দুল হাছিব মনিয়া, আব্দুল বারী, দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল। এ তিনজনের কাউকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মনোনয়ন জমা দিতে দেখা যায়নি। অংশ নিচ্ছেন না নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কোন বুদ্ধিদীপ্ত বৈঠকে। অথচ আসন্ন নির্বাচনে নৌকার বিজয়ে এ নায়কদের অংশগ্রহণ বড়ই জরুরি। তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব বদলাতে পারে ভোটের সকল হিসাব-নিকাশ। এমনটাই মনে করছেন নৌকাপ্রেমী আমজনতা।
বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারি হাজি আব্দুল হাছিব মনিয়া। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরেই আ’লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তাঁর নেতৃত্বে চারটি জাতীয় সংসদ এবং একটি উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি সফল ও সার্থক। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ এ রাজনীতিক একবারও নিজে জনপ্রতিনিধির আসনে বসার সুযোগ পাননি। এবার আশাবাদি ছিলেন উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন। পাননি, তাতে দুঃখ পেয়েছেন সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। অনুগতরা তাঁকে স্বতন্ত্রের মোড়কে বিদ্রোহী হতে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু আদর্শচ্যুত হতে রাজি হননি প্রাজ্ঞ এ রাজনীতিক।
আব্দুল হাছিব মনিয়া এখনো সরব হননি। এজন্য উপজেলা ও প্রত্যেক ইউনিয়ন আ’লীগের দায়িত্বশীলদের মধ্যেও নিরবতা লক্ষনীয়। ক্ষেত্রবিশেষ দলের অনেক শীর্ষ নেতা নৌকা ছেড়ে প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার একক দায়িত্ব নিতে পারবেন হাছিব মনিয়া। এমনটাই ভাবছেন তৃণমূল নেতাকর্মী।
বিয়ানীবাজারে আওয়ামী রাজনীতির এক আবশ্যকীয় নাম মো. আব্দুল বারী। তিনি পরপর দু’বার আ’লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এবার তারুণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হলে তিনিই হতেন নৌকার কান্ডারি, অনেকেই তা ভাবছিলেন। কিন্তু এবারও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানে আস্থা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে আব্দুল বারী ভেঙ্গে না পড়লেও আশাহত হয়েছেন। রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ করতে হয়তো হিসাব-নিকাশ মিলাচ্ছেন। তবে আব্দুল বারী অনুরাগীদের মতে, তিনি শিগগির জ্বলে উঠবেন। তাঁর নেতৃত্বেই যুবলীগ-ছাত্রলীগের ঐক্যবদ্ধ প্রচারণা নির্বাচনী মাঠের পুরো চিত্র পাল্টে দিবে।
এরশাদ ও জিয়া সরকারের আমলে উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ও যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বারীর হাত ধরেই আওয়ামী লীগ পরিবারে অজস নেতাকর্মীর আগমন ঘটে। তাদের অনেকেই আজ রাজনীতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। দৃঢ়চেতা রাজনীতিক আব্দুল বারীর নেতৃত্বে বিয়ানীবাজার থেকে পারিবারিক রাজনীতি তথা মোড়লিপনার অবসান হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে একাধারে পাঁচটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল। পাশাপাশি পরিবারতন্ত্রকে শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলি নয়, বিনাশ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর আজ আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ মুহূর্তে আব্দুল বারীর মতো তেজোদীপ্ত নেতৃত্বের বড়ই অভাববোধ করছেন নেতাকর্মীরা। যার হাতেই বিনাশ হয়েছিল পরিবারতন্ত্র, এ নির্বাচনে তাঁর হাতেই শোভা পাবে তাদের শিকড় উন্মোচন। এমনটাই ভাবছেন আব্দুল বারী সহকর্মীরা।
ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল। সম্ভবত ১৯৯৮ সালে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের জারুলতলায় ছাত্র সমাবেশে ‘রাজনীতির…বসন্তের হিসেব চাই’ অগ্নিমূর্ত বক্তব্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পদ। তখন গ্রুপ রাজনীতির আস্ফালনে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি। সফল কিংবা বিফল যাই হোন, রাজনীতি অঙ্গনে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন তখন। পরে উপজেলা আ’লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মনোনীত হন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম নাহিদের স্নেহধন্য হিসেবে বিশ্বস্তার পরীক্ষায় আউয়াল বারবার উত্তীর্ণ। এজন্য তিনি বিগত ১০ বছর শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের স্থানীয় কর্মকান্ড দেখভাল করেছেন। বিনিময়ে তৃণমূল নেতাকর্মীর সাথে গড়ে উঠেছে রাজনীতিরবন্ধন। এ হিসেবে দেওয়ান আউয়াল উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। ধারণা করেছিলেন, জনপ্রিয়তার নিরিখে তিনি নৌকা পাবেন এবং বিজয়ী হবেন। তাঁর সে স্বপ্ন বা আশা পূরণ করেননি শেখ হাসিনা। এজন্য নিরাশ হলে কিংবা রাজনীতির বদলে আঞ্চলিকতার ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টায় জড়িত হওয়া মোটেও সমীচিন হবে না। কারণ আউয়ালের কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করবে নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি’র বিগত ১০বছরের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন।
দেওয়ান আউয়ালের সামনে অপেক্ষা করছে রাজনীতির শীর্ষ পদ। এ মুহূর্তে তাঁকে দলীয় আনুগত্য মেনে সামনের সারিতে থেকে নৌকার বিজয়ে কাজ করা উচিত বলে অনেকেই মনে করছেন। কারণ, বিগত উপজেলা নির্বাচনে আউয়ালের সুদক্ষ নেতৃত্ব হ্যামিলনের বাঁশির মতো কাজ করেছিল। অনৈক্য ও ভুল বোঝাবুঝির দ্বৈতরথ পেরিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটার নৌকার পক্ষে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। তখন অনেকটা ডুবুডুবু নৌকা সময়ের স্রোতে দিনে দিনে বিজয় নিশানের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিল। এবারও দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়ালের প্রয়োজন রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এ প্রয়োজন যেমন নৌকার তেমনি তাঁর নিজেরও।
এদিকে রাজনীতিতে পাওয়া না পাওয়া, ভুল বোঝাবুঝি, দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস, অবিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক। এজন্য বিচলিত হলে কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তা ক্যারিয়ার গঠনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে। যারা দলীয় রাজনীতিতে শতভাগ বিশ্বস্ত থেকেও শেষ মুহূর্তে দলের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অপরাজনীতিতে নিমজ্জিত হয় তাদের ভবিষ্যৎ ক্ষণিকের জন্য আলোকময় হলেও অন্ধকার তাদেও পিছু ছাড়েনা। চোখ মেললেই এমন ভুরিভুরি প্রমাণ যেকোন সচেতন রাজনীতিক দেখতে পাবেন।
আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী পরিবারের নেতাকর্মীর কাছে হাজি আব্দুল হাছিব মনিয়া, মো. আব্দুল বারী, দেওয়ান মাকসুদুল ইসলাম আউয়াল-ই হচ্ছেন নায়ক। তাদের সরাসরি নেতৃত্বে অজস্র নেতাকর্মী নৌকা নিয়ে মাঠে পারফর্ম করতে চান। এক্ষেত্রে নিরবতা, আঞ্চলিকতা বা যেকোন ধরণের কৌশল মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ তাঁদের মধ্যে আগামীদিনের রাজনীতি, জনপ্রতিনিধির ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই রাজনীতির নায়ক মনিয়া বারী আউয়াল যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন তাহলে ইতিহাসে তাঁরা নায়কের বিপরীত উপাধিতে ভূষিত হওয়ার সমূহ সম্ভানা রয়েছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতির হিরোরা কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। নৌকার বিজয়ে তাদের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত-ই বিয়ানীবাজারের আগামীদিনের আওয়ামী রাজনীতির নতুন ইতিহাস।