সিলেটে আইসিইউর নামে বেসরকারী হাসপাতালে চলছে বাণিজ্য

বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণবিয়ানীবাজারবার্তা২৪.কম ডেস্ক:
আইয়ুব আলী (ছদ্মনাম)। হঠাৎ করে তার কিশোর ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় নিয়ে আসেন নগরীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে জানান, রোগীর অবস্থা ভাল না। খুব দ্রুত তাকে আইসিইতে নিতে হবে।
ছেলেকে বাচাঁতে নিরুপায় পিতা কোন উপায়ন্তুর না পেয়ে ডাক্তারের কথায় সম্মতি দিয়ে তাকে আইসিইউ ইউনিটে ভর্তি করার জন্য বলেন। ৩ দিন ছিল তার ছেলে আইসিইউ ইউনিটে। রোগী সুস্থ হয়েছে জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার ছেলেকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।
হাসপাতালে ৩ দিনের বিল দিতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে আইয়ুব আলীর মাথায়। ৩ দিনে তাকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার (ওষুধ ছাড়া) বিল হাতে ধরিয়ে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেক সুপারিশ করে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা দিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন তিনি।
জমিসংক্রান্ত বিরোধে গুরুত্বর আহত হয়ে ওসমানী হাসপাতালে জরুরী বিভাগে ভর্তি হন জৈন্তাপুরের এক মুদি ব্যবসায়ী। তার মাথায় জখম গুরুত্বর হওয়ায় চিকিৎসক তাকে আইসিইউতে রেফার করেন। কিন্তু হাসপাতালের স্থান সংকুলান না থাকায় তাকে ঐ দিন রাত ১২ টায় ভর্তি করা হয় বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউতে।
পরদিন দুপুরে তিনি মারা যান বলে চিকিৎসক রোগীর স্বজনদের নিশ্চিত করেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, রোগী বেঁচে আছেন। ২ দিন পর রোগীকে আইসিইউ থেকে মৃত অবস্থায় তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাথে ৪ দিনে আইসিইউর চিকিৎসা বাবদ ১ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় রোগীর স্বজনদের।
রোগীর স্বজনরা তাৎক্ষনিক ৬০ হাজার টাকা ও ঘন্টা খানেক পর বাকী টাকা দিবেন এই মর্মে লাশ নিয়ে যেতে চাইলে তা মানতে নারাজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। লাশ আটকে দেন হাসপাতাল কর্র্র্তৃপক্ষ। পরে টাকা দিয়ে লাশ ছাড়িয়ে নেন রোগীর স্বজনরা।
এ তো গেল ২ টি ঘটনা। এরকম নিত্যনৈমিত্তিক অনেক ঘটনা ঘটেছে সিলেটের আইসিইউ নামের বেসরকারী হাসপাতালের অভিনব ব্যবসায়। মৃত রোগীকে আইসিইউতে রেখে টাকা আদায়ের ঘটনা এখন নিত্যদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। লাইফ সাপোর্টের নামে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু হাসপাতাল ব্যবসায়ী যেন তেনভাবে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ সাজিয়ে প্রতারণার জাল পেতে বসেছেন।
ছোট খাটে অনেক বেসরকারী ক্লিনিকে এখন দুলছে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউয়ের সাইনবোর্ড। আর এসব হাসপাতালগুলোতে লাশ আটকে রেখে আইসিইউর ব্যবসা চলছে জমজমাট।
সিলেটের বেসরকারী হাসপাতাল গুলোতে গত কয়েকবছরে গড়ে তোলা হয়েছে আইসিইউ ইউনিট। যার বেশীরভাগে নেই আইসিইউ ইউনিট চালু করার প্রয়োজনীয় মেশিনারী। খবর নিয়ে জানা যায়, সিলেটের উচ্চমানসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ও সিসিইউতে প্রতিদিনের খরচ ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। মাঝারি মানসম্পন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে প্রতিদিন খরচ হয় ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
তবে মান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আইসিইউতে চিকিৎসা খরচ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ও সিসিইউর (করনারি কেয়ার ইউনিট) স্বল্পতা থাকায় রোগীরা বাধ্য হয়েই দালাল চক্রের প্রলোভনে পড়ে নিম্নমানের আইসিইউতে যেতে বাধ্য হন।
আর এ ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের আবেগকে পুঁজি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় অসাধু চক্র। এসব অসাধু চক্রের সাথে জড়িত রয়েছেন সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরাও। সরকারী হাসপাতালে আইসিইউতে সিট সংকুলান থাকায় অনেক ডাক্তার ও নার্সরা এসব রোগীর স্বজনদের বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউতে রোগীকে ভর্তি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। ফলে রোগীর স্বজনরা বাধ্য হয়ে এসব হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করান। প্রতি রোগীকে আইসিইউতে ভর্তির বিনিময়ে রেফারকৃত ডাক্তারকে দেওয়া হয় ঐ হাসপাতাল থেকে কমিশন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, আইসিইউর একটি সিট বাসাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়। একটি সিটের পেছনে হাসপাতালের দৈনিক খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। এটা ওষুধ ছাড়াই। একটি আইসিইউ ও সিসিইউতে দরকার হয় দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, উপযুক্ত চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স, টেকনেশিয়ান, পরীক্ষাগার। আইসিইউতে একজন রোগীকে ওঠানো-নামানো, বিভিন্ন দিকে ঘোরানোসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ভেন্টিলেটর এবং হƒদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেন মাত্রা, কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপের জন্য দরকার হয় কার্ডিয়াক মনিটর। স্যালাইনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম মাত্রা নির্ধারণের জন্য দরকার ইনফিউশন পাম্প। আইসিইউতে হƒদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার জন্য প্রয়োজন হয় শক মেশিনও। পাশাপাশি আইসিইউতে কিডনি ডায়ালিসিস মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম, মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণের জন্য এবিজি মেশিন থাকতে হবে। এ ছাড়া জরুরি পরীক্ষার জন্য আইসিইউর সঙ্গে একটি অত্যাধুনিক ল্যাব থাকা প্রয়োজন।
কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালের আইসিইউ ছাড়া বেশির ভাগ হাসপাতালের আইসিইউতে নেই এসব সুযোগ-সুবিধা। সরকারি নীতিমালা না থাকায় নিবিড় পরিচর্যার (ইনটেনসিভ কেয়ার) নামে এক শ্রেণির প্রতারক আইসিইউর নামে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নজরদারির অভাবে অসাধু চক্র একের পর এক তথাকথিত আইসিইউ-সিসিইউর নামে গড়ে তুলছে প্রতারণার ফাঁদ।
এ ব্যাপারে সিলেটের সিভিল সার্জন হিমাংশু লাল রায় জানান, সিলেটে আইসিইউ সেবা দেওয়ার মত প্রাইভেট স্পোশালাইজড হাসপাতাল গড়ে উঠেনি। অনেকগুলো হাসপাতাল স্বল্প পরিসরে আইসিইউ ইউনিট চালু করেছেন। কিন্তু দক্ষ চিকিৎসকের অভাবে সেসব হাসপাতাল সঠিকভাবে রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারছে না।
তাছাড়া অনেক গুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাধারণ রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে কোন রোগীকে আইসিইতে ভর্তি করতে হবে। তার কি আইসিইউতে সেবা নেওয়া দরকার কিনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর মরদেহ আটক করে স্বজনদের কাছ থেকে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন এমন অভিযোগ আমি এখনো পাইনি। অভিযোগ পেলে এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।