সমুদ্রপথে ইউরোপ যাত্রা ভয়ঙ্কর সেই রাতের বর্ণনা দিলেন মাছুম
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০১৯, ৩:৫১ অপরাহ্ণজাহিদ উদ্দিন, গোলাপগঞ্জ: তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবির ঘটনায় গোলাপগঞ্জের ৩জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান এই উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কদুপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে মাহফুজ আহমদ মাছুম (৩০)।
গত শুক্রবার (২৪ মে) ভোর ৫টা ৩৮ মিনিটে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের টিকে-৭১২ ফ্লাইট যোগে আরো ২জন বেঁচে ফেরা যাত্রীর সাথে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছালে অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় মারুফকে বিমানবন্দরে রেখেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ করেন। একদিন পর গত শনিবার সকাল ৯টায় মাছুম তার মাতা পিতার কোলে ফিরে আসে।গতকাল সোমবার মাহফুজ আহমদ এ প্রতিবেদককে বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক ঘটনা ও ভয়ঙ্কর সেই রাতের বর্ণনা দেন।
মাহফুজ বলেন, লিভিয়া থেকে সমুদ্র পথে ইতালি যাওয়ার জন্য গত ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় লিবিয়ার যুয়ারা এলাকা থেকে নৌকা করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে একটি নৌকা যাত্রা করে। ওইদিন রাতে আমরা তিউনিসিয়া উপকূলের কাছাকাছি আসলে সমুদ্রের বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় আমাদের বহনকারি নৌকাটি উল্টে যায়। সারা রাত প্রায় ১১ ঘন্টা সাগরে ভেসে ছিলাম আমরা।দালালরা প্রত্যেককে লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার কথা থাকলেও তারা দেয়নি। দিলে হয়তো এত যাত্রীর মৃত্যু হতনা। এছাড়াও আমাদের ছোট রাবারের নৌকাতে ৪০ জন যাত্রী তুলার কথা থাকলেও দালালরা জোর করে ৮০ জন যাত্রী তুলে।এসময় মাহফুজ আহমদ তার ছোট ভাই কামরান আহমদ মারুফ (২০) ও একই উপজেলার হাওরতলা গ্রামের মৃত রফিক মিয়ার ছেলে আফজাল মাহমুদকে (২৪) চোখের সামনে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যান।কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই মারুফ যখন আর সাতার কাটতে পারছিলোনা তখন আমি তাকে কাদে তুলে নিয়ে ছিলাম।অনেকক্ষণ কাধে তুলে সাঁতার কাটতে কাটতে আমিও আর পারছিলাম না। তখন তাকে আমি কাধ থেকে নামিয়ে হাতে ধরি। তারপর মারুফ অনেক্ষণ আমার হাত ধরে সাঁতার কাটে। এক পর্যায়ে সে বলে আমি আর পারছিনা ভাই তুমি আমার হাত ছেড়ে দাও। তুমি বাঁচার চেষ্টা কর। আমি ছাড়তে না চাইলেও সে জোর করে হাত ছেড়ে দেয়। এসময় আমার বাম দিকে আমাদের উপজেলার পাশ্ববর্তী ইউনিয়নের আফজাল মাহমুদও ছিল। সাতার কাটতে কাটতে হঠাৎ সেও আর পারছিনা বলে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে হারিয়ে যায়। চোখে সামনে এত মানুষের সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া দেখে নিজেও সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন চোখের সামনে আমার আদরের ছোট ভাই মারুফ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল তখন নিজে বাঁচার চেষ্টাটাও অনেক হারিয়ে ফেলেছিলাম।মাহফুজ বলেন, একতো ডুবে যাওয়ার ভয় ছিল সেই সাথে সমুদ্রের নানা প্রজাতির ভয়ংকর মাছগুলোও ছিল আরো ভয়ের কারণ। অনেকবার হাতে পায়ে মাছগুলো আঘাত করেছে।
সারা রাত সাঁতার কাটতে কাটতে যখন ভোর হয় তখন মাছ ধরার জন্য জেলেদের একটি নৌকা আমাদের কাছে আসে। তাদের সহযোগীতায় সমুদ্র থেকে ১৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। হয়তো আরো ১০ মিনিট পর জেলেরা আসলে অনেকেই সমুদ্রে হারিয়ে যেত।মাহফুজ আহমদ বলেন, আমি যদি মরে গিয়েও আমার ছোট ভাইটাকে বাঁচাতে পারতাম তাহলে মরে গিয়েও আমার কোন দুঃখ থাকতো না। এখন বেঁচেও আমি মরে আছি।উল্লেখ্য, গত ৯ মে লিবিয়ার উপকূল থেকে একটি বড় নৌকায় করে ইতালির উদ্দেশে রওনা দেন ৭৫ অভিবাসী। যার মধ্যে ৫১ জন ছিলেন বাংলাদেশি। গভীর সাগরে তাদের বড় নৌকা থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি নৌকায় তোলা হলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটি ডুবে যায়। এতে ৬৫ জন প্রাণ হারান।পরে ১১ মে নৌকা ডুবির ঘটনায় ৩৯ জন বাংলাদেশি নিখোঁজ থাকার কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ১৫ জনকে জীবিত উদ্ধার হওয়ার কথাও জানানো হয়। ২১ মে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) তত্ত্বাবধানে ও রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় উদ্ধার ১৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়।এ ঘটনায় জড়িত পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এছাড়া নৌকা ডুবে নিহত একজনের পরিবারের পক্ষ থেকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।এ নৌকাডুবির ঘটনায় সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কদুপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছোট ছেলে কামরান আহমদ মারুফ (২২) ও একই উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের হাওরতলা গ্রামের মৃত রফিক মিয়ার ৩য় পুত্র আফজল মাহমুদ (২৫) এবং উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের উত্তর গোলাপনগর গ্রামের মৃত মসব আলীর ছোট পুত্র আবুল কাসেম (২২) মারা যান।