জাতীয় সংসদ নির্বাচন: নৌকা-স্বতন্ত্রে ধরাশায়ী অনেক শীর্ষ নেতা
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ৮:৩৭ অপরাহ্ণদ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করায় দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উন্মুক্ত করার কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। এই অবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের সামনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই। এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি অনেক দলের শীর্ষ নেতারাও। আবার অনেক দলের প্রধানদের হার মানতে হয়েছে নৌকার কাছে।
এবার ১৪ দলের শরিক দলগুলোর তিনটি দলের ছয়জন নেতা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। তাদের মধ্যে জয়ী হয়েছেন মাত্র দুজন। তারা হলেন- জোট সমর্থনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বরিশাল-২ আসন থেকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও বগুড়া-৪ আসনে জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন। এর বাইরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বিজয়ী হয়েছেন।
গত তিন নির্বাচনের মতো এবারও রাজশাহী-২ (সদর) আসনে জোট থেকে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তবে তিনি জয়ী হতে পারেননি। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিকরা বাদশার পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নামলেও এবার ছিল ভিন্ন চিত্র। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবার সভা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিয়ে তার পক্ষে মাঠে নামেন। জয় নিয়েই ঘরে ফিরেন তারা। আসনটির বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায়, শফিকুর রহমান বাদশা কাঁচি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৯০৬ ভোট। আর বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) ফজলে হোসেন বাদশা পেয়েছেন ৩১ হাজার ৪৬৬ ভোট।
জোটের আরেক হেভিওয়েট নেতা জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিরোজপুর-২ আসনে টানা সাতবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু এবার তার সাম্রাজের পতন ঘটালেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ। মহিউদ্দিন ঈগল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৯৯ হাজার ২৬৮ ভোট, আর নৌকা নিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পেয়েছেন ৭০ হাজার ৬৮১ ভোট।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হলেও জয় নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেননি জাসদ নেতা মোশারফ হোসেন। সেখানে আওয়ামী লীড়ের স্বতন্ত্র প্রার্থী (ঈগল) মো. আব্দুল্লাহ ৪৬ হাজার ৩৭২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। আর মোশারফ হোসেন পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮১০ ভোট।
ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী নির্বাচন করেছিলেন সিলেট-৬ আসন থেকে। এক সময়ের বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা বারবার দলবদল করে এলাকায় অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিলেন। যার প্রভাব পড়ে ভোটের মাঠে। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ধারেকাছেও যেতে পারেননি তিনি। নাহিদ ৫৭ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে পঞ্চমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আর ১০ হাজার ৯৩৬ ভোট পেয়েছে তৃতীয় অবস্থানে শমসের মবিন চৌধুরী।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচন করেছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার। আসনটির বর্তমান এমপি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ধারেকাছেও যেতে পারেননি তিনি। তৈমুর মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। এর বিপরীতে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন গাজী।
এ ছাড়া তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে দলের নির্বাহী সভাপতি অন্তরা সেলিমা হুদা লড়ছেন মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে। এই আসনে নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদ ৯৫ হাজার ৮৬০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আর অন্তরা পেয়েছেন মাত্র ৬ হাজার ৩৩৭ ভোট। এই আসনটি থেকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীও ধরাশায়ী হয়েছেন মহিউদ্দিনের কাছে। দলটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবার ভোটযুদ্ধে নেই। ঋণখেলাপির অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল হয়েছে দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের। দলটির শীর্ষ দুই নেতা ভোটের মাঠে না থাকলেও আসনটির বর্তমান এমপি মাহী বি চৌধুরী ভোটে লড়াই করে ১৭ হাজার ৯৩৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে ভোটযুদ্ধে নামলেও জয়ী হতে পারেননি। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অনুপম শাহজাহান ৯৬ হাজার ৪০১ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। আর কাদের সিদ্দিকী পেয়েছেন ৬৭ হাজার ৫০১ ভোট।
বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে বের হয়ে এসে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে জোর আলোচনার জন্ম দিয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী না থাকায় এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার পক্ষে মাঠে নামায় তিনি কক্সবাজার-১ আসনে সহজেই জয় পেয়ে গেছেন। মোহাম্মদ ইবরাহিম পেয়েছেন ৮১ হাজার ৯৫৫ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি জাফর আলম পেয়েছেন ৫২ হাজার ৮৯৬ ভোট।
ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া আরেক রাজনৈতিক দল বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর প্রার্থী হয়েছিলেন ফরিদপুর-১ আসনে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে ধরাশায়ী হয়েছেন তিনি। আসনটিতে নৌকার প্রার্থী আব্দুর রহমান পেয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৩১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের আরিফুর রহমান দোলন পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৯৮৯ ভোট। জাফর ২২ হাজার ৪৬৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।
ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া আরেক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সভাপতি সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভাণ্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নির্বাচন করলেও জয়ী হতে পারেননি। আসনটিতে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৩৭০ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। আর সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভাণ্ডারী পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৩৮ ভোট। এই আসনে নির্বাচন করেছিলেন বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীও। তিনি পেয়েছেন মাত্র ২৩০ ভোট। তবে ভোটের দুই দিন আগে তিনি নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান।
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের নির্বাচন করেছেন দলটির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের আসন হিসেবে পরিচিত রংপুর-৩ (সদর) থেকে। এই আসনটি প্রায় ৪৮ বছর ধরেই জাপার দখলে। আসন সমঝোতায় আওয়ামী লীগ এবার রংপুর-৩ আসন জাপাকে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলে সরকারদলীয় প্রার্থী তুষার কান্তি মণ্ডল তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে সহজেই জয় পান তিনি। বেসরকারি ফল অনুযায়ী জিএম কাদের পেয়েছেন ৮১ হাজার ৮৬১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানী পেয়েছেন ২৩ হাজার ৩২৬ ভোট। অপরদিকে দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে টানা চতুর্থবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি পেয়েছে ৫৭ হাজার ৫৩০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অব.) নাসিমুল হক পেয়েছেন ৪২ হাজার ২৩৫ ভোট।
সিলেট-৫ আসন থেকে সিলেটের আঞ্চলিক সংগঠন আঞ্জুমানে আল ইসলাহ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা হুছাম উদ্দিন চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে চমক দেখিয়েছেন। তিনি কেটলি প্রতীকে ৪৭ হাজার ১৫৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাসুক উদ্দিন আহমদ নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩২ হাজার ৯৭৩ ভোট।