কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন: সাত বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ

বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মার্চ ২০১৯, ৯:৫৩ অপরাহ্ণবিয়ানীবাজারবার্তা২৪.কম, ডেস্ক।।
বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় দেড় দশক পর নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেয়া হয় কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল লাইন। কিন্তু সে উদ্যোগেও গতি নেই। এ সংক্রান্ত ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন’ নামের প্রকল্পটি গ্রহণের পর পেরিয়ে গেছে ৭ বছরের বেশি সময়। জুনে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদও।
কিন্তু জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এতগুলো বছরে ব্যয় হয়েছে ৬৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগর (আইএমইডি) এক পর্যালোচনায় উঠে আসে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের এ করুণ চিত্র।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. তানভিরুল ইসলাম বলেন, সোমবার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয় এবং বাস্তবায়নের গতি যাতে বৃদ্ধি পায় সেজন্য ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
তবে আমি মনে করি ঠিকাদার, পরামর্শক এবং রেলওয়ে ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় থাকলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ২ বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের বিপরীতে পরামর্শক নিয়োগ, ডিটেইলড ডিজাইন ও টেন্ডারিং সার্ভিস ইত্যাদি কাজ সম্পাদনে বিলম্ব হয়েছিল। ফলে প্রকল্পের মূল কাজ তথা পূর্ত কাজ সম্পাদনের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এছাড়া প্রথম দিকে মূল প্রকল্পটি গ্রহণের সময় সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের নিজস্ব তহবিলের অর্থে বাস্তবায়ন করা হবে।
কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া প্রথমে মিটার গেজ রেল লাইন তৈরির কথা থাকলেও পরে ব্রডগেজ রেল লাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব ছাড়াও পরামর্শক নিয়োগে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের মতামত পেতেই ৬ মাস সময় লেগে যায়। এরকম নানা জটিলতায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১১ সালে যখন প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সে সময় সরকারের নিজস্ব তহবিলের অর্থেই বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে ২০১৫ সালে বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে কানেকটিভিটির আওতায় কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনে (পুনর্বাসন প্রকল্প সংশোধিত) ফের ট্রেন চালুর লক্ষ্যে মে মাসের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে লক্ষ্যে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং প্রথম ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণ থেকে ৫৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। পরে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে এ প্রকল্পেরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু নানা জটিলতায় এখনও বাস্তবায়নের মূল কাজ শুরুই হয়নি।
অন্যদিকে মূল প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। সেটি সম্ভব না হওয়ায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। সেই সময়েও বাস্তবায়ন না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যেও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালের ৭ জুলাই মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল লাইনটি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। রেল লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৎকলীন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া এবং সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছয় থেকে সাত লাখ মানুষ যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে সমস্যায় পড়েন।
সড়কপথে ভাড়া বেশি হওয়ায় এলাকাবাসীর যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। জুড়ী, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলী, বড়লেখা, মুড়াউল ও শাহবাজপুর এ ছয়টি রেল স্টেশন স্থবির হয়ে পড়ে। ট্রেন চালুর দাবিতে বিভিন্ন সময়ে কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখার মানুষ সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে সভা-সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।
এরপর ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) এক বৈঠকে বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন নামে একটি প্রকল্প পাস হয়।
এ প্রকল্পে রেল লাইন পুনর্নির্মাণ, রেল স্টেশনের ভবন সংস্কার, সংকেত-ব্যবস্থার উন্নতিসহ ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল লাইন আধুনিকায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এগোয়নি। পরে ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়লেখা সফরকালে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ মাঠে আয়োজিত জনসভায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেল লাইন চালুর দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে রেল লাইন চালুর ঘোষণা দেন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, ২০১০ সালের ৭ আগস্ট ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণ চুক্তি সই হয়। পরে ২০ কোটি ডলার অনুদানে রূপান্তর করে ভারত। এর আওতায় ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব প্রকল্পের মধ্যে ১২টির কাজ শেষ হয়েছে। ৩টি কাজ চলমান রয়েছে। এ তিনটিতেই রয়েছে বড় অংকের বরাদ্দ। এর মধ্যে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল লাইন প্রকল্পটিও রয়েছে।