স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনো দল টেকেনি

বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১:৩৯ অপরাহ্ণবিয়ানীবাজারবার্তা২৪.কম।।।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও দল বিলুপ্তির প্রশ্নে জামায়াতে মতবিরোধ আবারও সামনে এসেছে। কয়েক দিন ধরেই জামায়াত নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার মধ্যে শুক্রবার পদত্যাগ করেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক।
এ নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। লন্ডনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদ।
প্রথম আলো: আপনি জামায়াতে ইসলামীতে যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন, তার একটা বিষয় ছিল ’৭১-এ দলের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া, আর অন্যটি দলের রাজনৈতিক ভাবাদর্শে পরিবর্তন। আপনি সামাজিক ন্যায়বিচারের রাজনীতির কথা বলেছেন। তো এই দুইয়ের মধ্যে কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমার মনে হয় দুটোই। কিন্তু আমি খুব খোলামেলাভাবেই বলব যে, ’৭১-এর জামায়াত দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। জামায়াত দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল। এটা আমাকে বেশি পীড়া দিয়েছে। ’৮১ সালে যে জন্ম নিয়েছে এবং জামায়াতের রাজনীতি করতে চায়, সে কেন জামায়াতের ওই বোঝা বহন করবে?
একাত্তরই আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। তা না হলে হয়তো আমি আরও কিছুদিন দলে থেকে সংস্কারের চেষ্টা করতাম। ’৭১-এর বিষয়ে আমি যেটা বলতে পারি সেটা হচ্ছে, একটি দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কেউ সে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন-এ রকম ইতিহাস আমি খুঁজে পাই না। সেটা জর্জ ওয়াশিংটনের কথাই বলেন, আর আমাদের উপমহাদেশের কথাই বলেন, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার ইতিহাস দেখুন।
প্রথম আলো: আপনি জামায়াতের রাজনীতি করছেন ৩০ বছর ধরে। তাহলে স্বাধীনতার পর আপনি জামায়াতে কেন যোগ দিলেন?
আবদুর রাজ্জাক: আসলে আমি তো একজন মুসলিম ডেমোক্র্যাট এবং ইসলামি মূল্যবোধ যেটা আমি তো মনে করি সেটিই সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। যদিও আমি মনে করি, ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর মধ্যেই ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। সুতরাং, এই মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর জন্যই আমি মনে করেছিলাম যে জামায়াত উপযুক্ত ফোরাম।
থম আলো: তখন জামায়াতে যোগ দেওয়ার সময়ে আপনার মনে হয়নি যে দলটির ’৭১-এর দায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
আবদুর রাজ্জাক: ওই সময় এটি কোনো বাধা ছিল না। ’৮৬-তে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ’৮৬-র নির্বাচনে বিএনপি আসেনি। কিন্তু, জামায়াত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অংশ নিয়েছে। তখন বিষয়টা বড় হয়ে ওঠেনি। ’৯০-তে আমার মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয় যে ’৭১-এর বিষয়টি নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
’৯০ সালে আমি চীনে এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে পাকিস্তান থেকে গিয়েছিলেন দেশটির প্রধান বিচারপতি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশটির বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ। তাঁরা ফেরার পথে ঢাকা হয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকায় তখন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং প্রধান বিচারপতি ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। পাকিস্তানের বিচারপতিরা ছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। তো সেখান থেকে বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ আমাকে ফোনে ডাকলেন।
উদীয়মান আইনজীবী হিসেবে তাঁরা আমাকে বেশ সম্মান দিয়েছিলেন। বিচারপতি শাহ আমাকে বললেন, দল হিসেবে ’৭১-এর বিষয়টির যদি সুরাহা না করতে পারো, তাহলে জামায়াত বেশি দূর এগোতে পারবে না।
২০০১ সালে ক্ষমা চাইতে বলি
প্রথম আলো: তখন থেকে ২০১৯-এই সময়ের মধ্যে আপনি পাঁচটি সময় উল্লেখ করেছেন; ২০০১, ২০০৫, ২০০৭-০৮, ২০১১ এবং ২০১৬, যখন আপনি লিখিতভাবে সংস্কারের কথা বলেছেন। এত দীর্ঘ সময় কেন অপেক্ষা করলেন?
আবদুর রাজ্জাক: ১৯৯৪ সালে যখন গোলাম আযম সাহেবের নাগরিকত্বের বিষয়টি সমাধান হয়ে গেল, তখনই আমি মত দিই যে আমাদের মাফ চাওয়া উচিত।
প্রথম আলো: ব্যক্তিগতভাবে আপনি সরাসরি বলেছিলেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমি ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনায় তুলেছি। তবে, আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে তখন নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, যেটা ২০০১ সালে বলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের সহায়তা নিয়েছিলাম, যাঁদের দুজন এখনো জীবিত আছেন। আমি লিখিতভাবে খসড়া বিবৃতি তৈরি করে দিয়েছিলাম। সে বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি হবে বলে আশা করেছিলাম।
আমি খুব খোলামেলাভাবেই বলব যে, ’৭১-এর জামায়াত দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। জামায়াত দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম আলো: আপনি পদত্যাগপত্রে বলেছেন যে তিন দশক ধরে আপনি দলটিতে সংস্কার করতে চেয়েও তা পারেননি এবং সে কারণেই পদত্যাগ করেছেন। কী সংস্কার করতে চেয়েছেন?
আবদুর রাজ্জাক: প্রথমে আমি চাইছিলাম যে জামায়াতে কাঠামোগত পরিবর্তন হোক। কাঠামোটা বড্ড অনমনীয়, সেটা আরেকটু নমনীয় করা যায় কি না। যেমন, দলের নেতৃত্বে নারী প্রতিনিধিত্ব নেই। অথচ জামায়াতে প্রচুর নারীর অংশগ্রহণ আছে। কিন্তু সেই অনুপাতে দলে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব পর্যাপ্ত নয়।
প্রথম আলো: উদ্দেশ্যটা কী? রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন?
আবদুর রাজ্জাক: একটা দেশকে যদি আপনি প্রতিনিধিত্ব করতে চান, তাহলে দেশের বাস্তবতাটা বুঝতে হবে। আপনি রাজনীতি করছেন, তাই রাজনৈতিকভাবে অন্যকে মোকাবিলার জন্য প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। মনে করেন মিসরে ব্রাদারহুড ছিল। কিন্তু তারা সেটাকে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি করে তার পরিব্যাপ্তিটা অনেক বাড়াতে পেরেছিল। তুরস্কের একে পার্টির ইতিহাস দেখুন। সেখানে তারা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। দলে পরিবর্তন না ঘটালে তারা এভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়তে পারত না। সেখানে তারা কারচুপি করে ক্ষমতায় আসেনি। আমার কথা ছিল, আমাদেরও দলে সংস্কার আনতে হবে।
একবার ফরাসি দূতাবাসের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হলো। তাঁদের আমাদের দলের একটা সাময়িকী দেওয়া হলো, যেটি নারীরা তৈরি করেছেন। তাঁরা বললেন, সাময়িকীতে যত ছবি ছাপা হয়েছে, সবাই পুরুষ। এতে নেকাব পরা নারীদের ছবিও তো থাকতে পারত। এটা তো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আপনি নারীদের শুধু বিশেষ কোটায় নেবেন কেন? জামায়াতে তো অনেক শিক্ষিত ও যোগ্য নারী আছেন। সংস্কারের এসব কথা আমি বলেছি।
উগ্রপন্থা প্রতিষ্ঠার অভিযোগ
প্রথম আলো: নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয় তো একটা দিক মাত্র। কিন্তু জামায়াতের রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন? জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, দলটি র্যাডিক্যাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে ক্ষেত্রে কী পরিবর্তনের কথা ছিল?
আবদুর রাজ্জাক: জামায়াতে ইসলামী সমাজব্যবস্থার কথা বলে। কিন্তু র্যাডিক্যাল ইসলাম বলতে যা বোঝায়, সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রপন্থা—সেটা জামায়াতের রাজনীতি নয়।
১৯৯৪ সালে যখন গোলাম আযম সাহেবের নাগরিকত্বের বিষয়টি সমাধান হয়ে গেল, তখনই আমি মত দিই যে আমাদের মাফ চাওয়া উচিত।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনাদের স্লোগান, ‘আল্লাহর আইন চাই’, গঠনতন্ত্রের ঘোষণা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব—এসব বিষয়কে আপনাদের সমালোচকেরা র্যাডিক্যাল ইসলাম বলেই অভিহিত করে থাকেন।
আবদুর রাজ্জাক: র্যাডিক্যাল বলতে বোঝায় সন্ত্রাসবাদ। জামায়াত কিন্তু উদার (মডারেট) ইসলামের রাজনীতিকেই গ্রহণ করেছে। অন্যান্য মুসলিম দেশও সেটাই গ্রহণ করেছে। দেখুন, ’৪৭-এর জামায়াত, ’৭১-এর জামায়াত, আর ২০১৯ সালের জামায়াত তো এক নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পরিবর্তন ঘটছে। ১৮৮০ সালে যখন কংগ্রেস গঠিত হয়, তখন তার নেতা হয়েছিলেন একজন স্কটিশ।
পরে সুভাষ বোস, জওহরলাল নেহরু, তারপর ইন্দিরা গান্ধী। তাঁদের প্রত্যেকের সময়েই দলটিতে পরিবর্তন এসেছে। মুসলিম লীগ হয়েছিল ১৯০৬ সালে, স্যার সলিমুল্লাহ তার নেতা ছিলেন। সলিমুল্লাহর মুসলিম লীগ আর জিন্নাহর মুসলিম লীগ এক ছিল না। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন হয়। সেই পরিবর্তন করতে হবে।
রাজনীতি দূষিত হয়ে গেছে, নতুন দল করছি না
প্রথম আলো: আপনার পুরোনো সহকর্মীরা যদি অভিযোগ করেন যে আপনি তাঁদের দুর্দিনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের ক্ষতি করেছেন এবং এর পেছনে আপনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আপনার জবাব কী?
আবদুর রাজ্জাক: সেটা ঠিক হবে না। কারণ, দলের সবচেয়ে সুসময় ছিল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল। আমরা তখন ক্ষমতার অংশীদার ছিলাম। তখনই তো আমি কথাটি তুলেছিলাম। এখন আমি বুঝতে পারছি যে জামায়াতকে আমার আর কিছু দেওয়ার নেই। আর জামায়াতের দুর্দিন এখন তো বোধ হয় কমে গেছে। সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে দলের পাঁচজন নেতার বিচার এবং ফাঁসির সময়। আমি তো তখন আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমি জানতাম, তৃতীয় বিশ্বের দেশে অভিযুক্তের পক্ষ সমর্থন করা সহজ নয়।
একটা দেশকে যদি আপনি প্রতিনিধিত্ব করতে চান, তাহলে দেশের বাস্তবতাটা বুঝতে হবে।
প্রথম আলো: তাঁরা যদি বলেন আপনি দল ত্যাগ করেছেন কোনো উদ্দেশ্য থেকে। কী বলবেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমি দলত্যাগ করেছি নৈতিকতার উচ্চ অবস্থান থেকে।
প্রথম আলো: কী করার জন্য? ব্যক্তি হিসেবে আপনি একা কী করতে পারবেন?
আবদুর রাজ্জাক: আমি কোনো সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে যাচ্ছি না।
প্রথম আলো: একেবারে নিশ্চিত? এমনকি, আপনার নীতি সমর্থন করায় দল থেকে যাঁরা বহিষ্কৃত হচ্ছেন বা দলের ভেতরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন, তাঁরা চাইলেও না?
আবদুর রাজ্জাক: আমি কোনো নতুন দল করছি না এবং কোনো বিদ্যমান দলেও যোগ দিচ্ছি না। একেবারে নিশ্চিত করে বলছি।
এখন আমি বুঝতে পারছি যে জামায়াতকে আমার আর কিছু দেওয়ার নেই।
প্রথম আলো: জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদে আপনার মতামতের অনুরূপ সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং তাতে দলের নতুন নামে সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি ছিল, যা মজলিশে শুরা গ্রহণ করেনি। স্পষ্টতই দলের দুটো ধারা। এখন একটি পক্ষ যদি একে পার্টির মতো নতুন রূপে আত্মপ্রকাশের উদ্যোগ নেয়, আপনি তাতে যুক্ত হবেন না?
আবদুর রাজ্জাক: আমি নতুন কোনো দল করছি না, কোনো দলে যোগ দিচ্ছি না। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতি খুব টক্সিক (দূষিত) হয়ে গেছে। এখান থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে কোনো রাজনৈতিক দলে গিয়ে আমি কোনো অবদান রাখতে পারব না। আমি মনে করি, সিভিল সোসাইটির হয়ে বরং আমি কিছু করার চেষ্টা করতে পারি। আপনি দেখেন রাজনীতি কতটা টক্সিক হয়েছে।
আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইতে উনি লিখেছেন যে ’৫৪ সালের নির্বাচনে আমরা যখন দেখলাম যুক্তফ্রন্টের প্রতিপক্ষের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা বললাম কিছু ভোট তাদের বাক্সে দাও যেন তাদের জামানত রক্ষা হয়।
আজকের বাংলাদেশে আপনি আমার প্রতিপক্ষ হলে আপনাকে পরাজিত করেই আমি খুশি হব না, আপনাকে শারীরিকভাবে নির্মূল করতে পারলেই আমি খুশি হব। এখানে সিভিল সোসাইটিকে ভূমিকা নিতে হবে। আমেরিকান এমবাসিতে এক দাওয়াতে আমি, মওদুদ সাহেব এবং আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। ওই মন্ত্রী দুঃখের সঙ্গে বললেন যে বিএনপির একজন নেতা মারা গেছেন শুনে জানাজায় যাওয়ার জন্য তিনি পোশাক পরে তৈরি হওয়ার পর তাঁকে টেলিফোনে সেখানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তখনকার চেয়ে পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। এখানে যদি ভালো কিছু করতে হয় তাহলে আমার মতো মানুষের জন্য সিভিল সোসাইটি ছাড়া আর কাজ করার জায়গা নেই।
প্রথম আলো: কিন্তু বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটিও তো চাপের মধ্যে আছে?
আবদুর রাজ্জাক: চাপের মধ্যে আছে। কিন্তু সিভিল সোসাইটির বড় সমস্যা হচ্ছে দলীয় বিভাজন।
প্রথম আলো: সেই দলীয় আনুগত্যভিত্তিক বিভাজন তো আপনিও দূর করতে পারবেন না।
আবদুর রাজ্জাক: আমার মনে হয় সেখানে চেষ্টা করার সুযোগ এখনো আছে।
প্রথম আলো: জামায়াতকে পাশ্চাত্যের অনেক দেশ উদার ইসলামপন্থী রাজনীতির ধারক হিসেবে গ্রহণ করার পথে অগ্রসর হয়েছিল।
আবদুর রাজ্জাক: পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমার মাধ্যমেই যোগাযোগটা হতো। ২০০৩ সাল থেকে আমি যাওয়া আসা করি। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কংগ্রেস এগুলোতে আমার যাওয়া-আসা ছিল। মীর কাসেম আলীর যে ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তার মাধ্যমেই যোগাযোগ হতো। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার হওয়ার পর হয়তো তাঁদের কেউ কেউ এখন আর সম্পর্কের ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নন। তবে একেবারে সম্পর্ক নেই, তা নয়। এখনো দূতাবাস থেকে যোগাযোগ করা হয়। আমি গত অক্টোবরে গিয়েছি। সেখানকার সিভিল সোসাইটিতে আমার বন্ধুবান্ধব আছে।
বোমা হামলা ও সহিংসতা
প্রথম আলো: কিন্তু অবস্থাটা তো বদলে গেছে। এর কারণ কী এই যে বাংলাদেশে জেএমবির ৬৩ জেলায় বোমা হামলা এবং বাংলা ভাইয়ের উত্থানের মতো সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোয় জামায়াতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে? মতিউর রহমান নিজামী বাংলা ভাইকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে নাকচ করার চেষ্টা কি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেনি?
আবদুর রাজ্জাক: বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি—এ কথা তিনি বলেছিলেন মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছিল সেই পটভূমিতে। আর সে সময়ে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার ঘটনা তো বাস্তবতা।
আমি দলত্যাগ করেছি নৈতিকতার উচ্চ অবস্থান থেকে।
প্রথম আলো: কিন্তু ইসলামের নামে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে জামায়াত সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই দলের ক্ষতি করেছে?
আবদুর রাজ্জাক: এটা সবাই জানে, সন্ত্রাসের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা জামাতের দর্শনের পরিপন্থী। এটা যারা সহ্য করতে পারেনি, তারা জামায়াত ছেড়ে গেছে। তাতেই কিন্তু প্রমাণ হয় জামায়াত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো: ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনার বিষয়েও তো জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আবদুর রাজ্জাক: অনেক পুরোনো কথা, আমার মনে নেই কী হয়েছিল। কিন্তু একটা কথা আমি বলতে পারি, আমি এখন জামায়াতে নেই। কিন্তু জামায়াত সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, সব সময় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। তাই এটা বলা সঠিক হবে না। জামায়াতের ওপর অপবাদ চাপানো হবে।
প্রথম আলো: দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যেসব সহিংসতা হয়েছে, বাড়িঘর পোড়ানো, বাসে আগুন দেওয়া—এসবের দায় তো জামায়াতের ওপর বর্তায়?
আবদুর রাজ্জাক: দেখুন, রাজনীতিতে সহিংসতার বিষয়টি পুরোনো। এগুলো আগেও তো হয়েছে। তবে জামায়াত অবস্থান নিয়েছে সহিংসতার বিরুদ্ধে। কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। কিন্তু বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের মতো পরিবেশ আছে কি?
ইসলামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ
প্রথম আলো: বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী?
আবদুর রাজ্জাক: আমি মনে করি মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশে এখন যে ধারাটা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জরুরি। একে পার্টি এবং এন্নাহাদা পার্টির (তিউনিসিয়া) মডেলে তরুণেরা এগিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। তবে আমি আমার লেখায় বলেছি যে ’৭১ নিয়ে কোনো আপস হবে না।
প্রথম আলো: তার মানে সেটাও তো জামায়াতের একটি উপজাত দল হবে?
আবদুর রাজ্জাক: এটা সময়ের দাবি। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অধীনে মুসলিম উদার গণতান্ত্রিক দলের প্রয়োজন এবং সম্ভাবনা আমি দেখছি।
আমি নতুন কোনো দল করছি না, কোনো দলে যোগ দিচ্ছি না। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতি খুব টক্সিক (দূষিত) হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে বলে মনে হয়? বিশেষ করে মজলিশে শুরা তো পরিবর্তনের পক্ষে নয় বলেই মনে হচ্ছে।
আবদুর রাজ্জাক: মজলিশে শুরা যে একেবারেই পরিবর্তনের পক্ষে নয়, সেটা বলা যাবে না। সম্প্রতি তারা কিছু ভালো সিদ্ধান্ত তো নিয়েছে। আমি যে দুটি প্রস্তাব দিয়েছি তারা তা গ্রহণ করলে তাদের ভালো সম্ভাবনা আছে। দলটির মধ্যে এখনো উদার দৃষ্টির লোক আছেন। তাঁদের নাম বলতে চাই না। তাঁরা সংখ্যায় কম। কিন্তু পারলেও পারতে পারেন।