বছর চল্লিশেক কাছাকাছি, পাশাপাশি। চোখের নৈকট্যে কবি ও আমি। লুকায়িত প্রকাশিত অনেক শব্দমালার সাক্ষী। আমি তাঁর যাপিত সময়ের নীরব দর্শক। এ যেন এক নিভৃত যুদ্ধ কবির নিজের সাথে, নিজের মানষপটের সাথে। বিরামহীন এ যুদ্ধ কবির পার্থিব জীবনের সাথে জড়ায় কখনো।
কবি যেমন কবিতা চরনের উপর দিয়ে অতিক্রম করতেন সময়, তেমনি জীবনের বিঘ্নসংকুল পাড়ি দিতেন চুপিসারে। কবি হেঁটেছেন কাটাময় পথে। কখনো কাটারা পিছন থেকে ধাওয়া করত কবিকে। কম উপহাসেরও শিকার হননি। কবিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠত।
বৈশ্বয়িক জীবন যুদ্ধ বাদ দিলে কবির কবিতা চর্চার ব্যাপ্তিই তাঁর পার্থিব জীবন। শুদ্ধতার যুদ্ধ চলে তাঁর। শুদ্ধ কবিতার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে নিরন্তর চেষ্টা চলে এখনো।
কবি জন্মেছেন অনিপন্ডিতের লাগোয়া বাড়িতে। সীমানা প্রতিবেশী। কবি বাসুদেব রথযাত্রার মুয়ামুড়ি খেয়ে বালকবেলা মাড়িয়ে গৌড়ের বাড়ি পেরিয়ে বঙ্গের ঐতিহ্যের শ্রীহট্টে পা রাখেন এক সময়। তখন শ্রীহট্ট রূপ পাল্টিয়ে সিলেটের লেবাস পরেছে। কবির চোখে ভাসে পুরনোর ছন্দপতন। নতুনের লাগ ভেলকি কবিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।
কবির সাদামাটা জীবনের ছোঁয়ায় আবার অলঙ্কৃত হয় শ্রীভূমির পঞ্চখন্ড। যেখানে কবির সূতিকাগার, সেই ধুলো-মাটি কাদা মাখা ডেফল-থৈকরের নীড়ে অবস্থান নেন তিনি।
পঞ্চখন্ডের ঐতিহ্য বকুল হোটেলের সেই পুরনো-ভাঙা চেয়ার টেবিলে কত সময় পার করেছি আমি ও কবি তার কি ইয়ত্তা আছে। আমাদের শক্তি-শিক্ষার সাগর পঞ্চখন্ড হগগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাড়ে কত বিকেল কাটিয়েছি সূর্যের হলদে আভা গায়ে মেখে।
কবির কবিতা নিয়ে বলার ঔদ্ধত্য আমার নেই। সর্বদা টের পেতাম কি যেন এক আলোড়ন কবির মস্তিকে। যে আলোড়ন প্রসবে প্রস্ফুটিত হত বাতিঘর হয়ে, মাটি-মানুষের কথা হয়ে, জীবনের কথা হয়ে। এর এক নিগূঢ় প্রভাব পড়ত আমার গায়ে।
শুনছি, দেখছি ইদানিং কবি বৈশ্বয়িক প্রেক্ষিপটে মহীরুহের অঙ্কুর গজিয়েছেন। গাছ বড় হবে পাতা-পল্লব ছড়াবে। পাখি গান করবে এবং কবি বক্ষ বেয়ে কবির-মস্তিস্ক থেকে নির্মল কথামালা বেরুবে। তারই ছায়াতলে কোনো এক সময় কেউ স্বস্তি খোঁজবে, প্রশান্তির নিঃশ্বাস টানবে শুদ্ধ কবিতায়- সেই বিশ্বাস রইল।
কবি ফজলুল হকের আজ জন্মবার্ষিকী। কবি বেঁচে থাকুন শুদ্ধতায়। আরো ছড়িয়ে দিন আলো, আরো আলো। ঘরভর্তি আলো। আলোয় আলোকিত হোক সংসার।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।