ইয়াকুব আলী খান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের সতীর্থ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার। একসঙ্গে তারা ক্লাসে গেছেন। একই হোস্টেলে থেকেছেন। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে আড্ডাও দিয়েছেন। একই বছর বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন এবং পাস করেছেন। ইসলামিয়া কলেজে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনও করেছেন তিনি। সতীর্থ হিসেবে তার সঙ্গে তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল শেখ মুজিবের। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে নিজের বাসায় বসবাস করছেন বঙ্গবন্ধুর এই সহপাঠী।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। দুই বন্ধুর ইসলামিয়া কলেজ, হোস্টেল এবং কলকাতার সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন ইয়াকুব আলী খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ সংবাদদাতা ফজলুল হক শাওন।
জাগো নিউজ : আপনার জন্মস্থান কোথায় এবং কত সালে? কোন সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন?
ইয়াকুব আলী খান : আমার জন্ম ১৯২৫ সালের ১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার মীর বাজার এলাকায়। একটি মুসলিম পারিবারে আমি জন্মগ্রহণ করি। পাঁচলা আজিম ইনস্টিটিউট থেকে আমি মেট্রিক পরীক্ষা দেই। সেখান থেকে পাস করার পর ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হই। এই কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও গ্র্যাজুয়েশন করি।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয় কখন, কীভাবে?
ইয়াকুব আলী খান : আমি যখন ইসলামিয়া কলেজে ইতিহাস বিষয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করি, তখন আমাদের ক্লাসে ২০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্যে প্রথম কথা হয় শেখ মুজিবের সঙ্গেই। ক্লাস শুরুর ৮ থেকে ১০ দিনের মাথায় তার সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। শেখ মুজিব সবার সঙ্গে কথা বলতেন। হাসিমুখে কথা বলে ক্লাসের সবার মন জয় করে নেন। এছাড়া দুজন একই হোস্টেলের শুনে মুজিব প্রথম বুকে টেনে নেন আমাকে। জন্মতারিখ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাদের চেয়ে বড় ছিলেন। শুনেছি ছোট বেলায় বেরিবেরি রোগ হওয়ায় এবং ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতি করার কারণে বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনায় কিছুটা গ্যাপ হয়ে যায়।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিল?
ইয়াকুব আলী খান : আমাদের দুজনের মধ্যে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। একই হোস্টেলে থেকেছি। তিনি আমাকে সব সময় হাওড়া বলে ডাকতেন। আমার বাড়ি যেহেতু ছিল হাওড়ার মীর বাজার এলাকায়, খানিকটা দূরে গেলেই হাত তুলে ডাকতেন ‘এই হাওড়া, এদিক আয়’। একদিন দেখা না হলে বলতেন, ‘কোথায় থাকিস, কাল কোথায় ছিলি, দেখা হলো না কেন?’
জাগো নিউজ : কলেজে পড়ার সময় আপনারা কি কোনো সংগঠন করতেন?
ইয়াকুব আলী খান : কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে শেখ মুজিবের সঙ্গে আমরা ছাত্র সংগঠন করেছি। সংগঠনের নাম ছিল ‘অল বেঙ্গল ইস্ট মুসলিম লীগ’। একজন ছাত্রনেতার যে সব গুণাবলী থাকা দরকার বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তার সবই ছিল। তিনি ছাত্র ও সহপাঠীদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতেন যে ছাত্ররাও তার কথায় মুগ্ধ হয়ে যেতেন। একবার যে ছাত্রের সঙ্গে তার কথা হতো, তিনিই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে যেতেন।
জাগো নিউজ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নেন, তারপর কি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন বা দেখা হতো?
ইয়াকুব আলী খান : বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি, তখন আমি পরিসংখ্যান ব্যুরোতে অফিসার হিসেবে চাকরি করি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ওনার তো প্রটোকল ছিল। ইচ্ছা করলেই তার সঙ্গে দেখা করা যেত না। তারপরও মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে যখন আমাদের ডাক পড়ত তখন যেতাম। তখনও বঙ্গবন্ধু আমাকে হাওড়া বলেই ডাকতেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দুবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ট্রেনিংয়ে বিদেশ যাই। ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুকে আর পাইনি। ঘাতকরা তাকে শেষ করে দিয়েছে। বিদেশে থাকাবস্থায় খবরটি পেয়েছিলাম। কয়েকদিন ঠিক মতো চলাফেরা করতে পারিনি। রুমে বসে বসে চোখের পানি ফেলেছি।
জাগো নিউজ : ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সরকার মুজিববর্ষ পালন করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ইয়াকুব আলী খান : আমার বন্ধু, আমার সহপাঠীর নামে বর্ষ ঘোষণা হয়েছে, এ কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, খুব খুশি আমি। খবরে আমি শুনেছি, শুধু বাংলাদেশে নয়, ইউনেস্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুজিববর্ষ পালন করার জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এটা আমাদের বাংলার সব মানুষের জন্য গৌরবের। এসব কথা শুনে আমি এত খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
জাগো নিউজ : এই বয়সে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা কি মনে পড়ে? কখন কোন অবস্থায় মনে পড়ে?
ইয়াকুব আলী খান : টেলিভিশনে বা খবরের কাগজে যখন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো খবর দেখি বা পড়ি তখন তার কথা খুব বেশি মনে পড়ে। তখন মনে পড়ে বেকার হোস্টেলের কথা, মনে পড়ে কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দেয়ার কথা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা। আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি, বেকার হোস্টেলে থেকেছি, একসঙ্গে বিএ পরীক্ষা দিয়েছি, একই রুমে আমার আর বঙ্গবন্ধুর সিট পড়েছিল। আমি বেকার হোস্টেলের ১০৩ নম্বর রুমে থাকতাম। বঙ্গবন্ধু মাঝেমধ্যে আমার রুমে আসতেন, কথা বলতেন। একটা আড্ডার জায়গায় বসলেও সহপাঠীদের বলতেন, কারও কোনো অসুবিধা আছে কি-না। থাকলে অসুবিধা দূর করার সমাধানও দিতেন। আর যেখানেই যেতাম তার সঙ্গে, সেখানে তার রাজনৈতিক কথা থাকতই। বিশেষ করে আগস্ট মাস এলে টেলিভিশনে যখন বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখি, তখন কান্না ধরে রাখতে পারি না। যখন কোনো মাইকে তার ভাষণ বাজায়, তখন বিভিন্ন স্মৃতি মনে পড়ে। তখন বেদনায় আরও বেশি কাতর হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে কোনো খাবার নিয়ে গেলে আমাকে ছাড়া খেতেন না, এ কথা আরও বেশি মনে পড়ে, তখন কান্না ধরে রাখতে পারি না।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের আর কার কার সঙ্গে চলাফেরা-আড্ডা হতো, সেগুলো কি মনে আছে?
ইয়াকুব আলী খান : মুজিব ও আমি যখন বেকার হোস্টেল ছিলাম, তখন হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান (খ্যাতিমান সাংবাদিক শফিক রেহমানের বাবা)। হোস্টেলে আরও অনেক বন্ধু ছিল। ফরিদপুরের শামসুদ্দিন মোল্লা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে শামসুদ্দিন মোল্লা ফরিদপুরের গভর্নর নির্বাচিত হন। তিনিও আমাদের সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন (দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক) ছিলেন। তার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর খোঁজ-খবর নিতাম। আমাদের সাথে আরও পড়তেন পাবনার খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, যিনি ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ বই লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন, যিনি ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি বাকশালের চেয়ারম্যান হন। ঢাকায় ছিলেন সালাউদ্দিন আহমেদ। এদের সবার সঙ্গে আমার ‘তুই-তোকারি’ সম্পর্ক ছিল।
জাগো নিউজ : আপনার সহপাঠী বঙ্গবন্ধুর কন্যা এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তার বাবার সহপাঠী হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে আপনার কোনো চাওয়া বা প্রত্যাশা আছে কি-না?
ইয়াকুব আলী খান : প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন সহপাঠীর মেয়ে হিসেবে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার শেষ ইচ্ছা, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে বন্ধুর মেয়েকে একবার দোয়া করে যেতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। শেখ হাসিনার কাছে আমার কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই।