আবেদনে এগিয়ে নারীরা ॥ ৯ বছরে ১৪৩৯ জনের আবেদন ॥ ছয় মাস কিংবা এক বছর থেকে শুরু করে ২৭ বছরের সংসারের ডিভোর্সের আবেদন পড়ছে ॥ মেয়র আরিফ।
আধুনিক লাইফ স্টাইল এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা দায়ী ॥ ডা: আর কে এস রয়েল
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সে অধ্যয়নরত ছাত্রী শিল্পী (ছদ্মনাম)। ২০১৮ সালের প্রথমার্ধ্বে ঘটক তার বিয়ের আলাপ নিয়ে হাজির হয় অভিভাবকের কাছে। পাত্র লন্ডন প্রবাসী। পাত্র দেখে পছন্দ হলো কনে পক্ষের। ১০ লাখ টাকা দেন মোহরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ওই বছরই বিয়ে হলো তাদের।
বিয়ের সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় বর চলে গেলেন লন্ডনে। এরপর থেকে বর লাপাত্তা । কনের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। কনেকে দেয়া ঠিকানাটিও ছিল ভুয়া। মোবাইল চালু থাকলেও স্ত্রীর সাথে তার কোন যোগাযোগই ছিল না। এর কিছুদিন পর সেটিরও সংযোগ বন্ধ করে দেন।
কনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় একেবারে। এ অবস্থায় কনে বাধ্য হয়ে বিয়ের ১০ মাসের মাথায় বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনে (সিসিক)। বিচ্ছেদের আবেদনটি এখন শুনানীর পর্যায়ে আছে।
কেবল শিল্পী নন, গত ৯ বছরে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৮৮১ জন নারী বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। আর বিচ্ছেদের জন্য পুরুষ আবেদনকারীর সংখ্যা ৫৫৮ জন। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে-সবমিলিয়ে ১৪৩৯টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পড়ে।
২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতি মাসে গড়ে ২৪টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পড়ছে। এ বছর সবমিলিয়ে আবেদন পড়ে ২৯৪টি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিবাহ বিচ্ছেদও কার্যকর হয়েছে বলে সিসিক সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পড়ে ২৫৫টি। এর মধ্যে মহিলা ১৭১ এবং পুরুষ ৮৪। ওই বছর ২৯টি বিচ্ছেদ কার্যকর হয়।
বিচ্ছেদের আবেদনে শিল্পী উল্লেখ করেন, ‘মানসিক, পারিবারিক,যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ও অশান্তির কারণে স্বামীর সাথে তার সংসার পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় আমি গভীরভাবে চিন্তা ও বিবেচনার পর স্বাক্ষীগণের উপস্থিতিতে কাবিননামায় দেয়া ১৮ নং কলামের ক্ষমতাবলে তাকে তিন তালাক প্রদান করে তার জওজিয়ত হতে চিরমুক্তি নিলাম।’
সিসিকে জমা পড়া আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বামী কিংবা স্ত্রীর প্রবাসে অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন পরস্পর পরস্পর থেকে দূরে থাকা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সন্দেহ, যৌতুক দাবি, সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, স্বামী-স্ত্রীর জীবন-যাপনে অমিল, সন্তান-সন্তানাদি না হওয়া, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মাদকে আসক্তি ইত্যাদি কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। মিল না হওয়ায় অনেক উচ্চ শিক্ষিত দম্পতিও বিচ্ছেদের আবেদনের তালিকায় রয়েছেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও নগরীর রায়নগর এলাকার বাসিন্দা প্রবাসী রিয়াজুর রহমান স্ত্রী রিনা বেগমের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে স্ত্রীকে বিচ্ছেদের জন্য ডাকযোগে আবেদন করেছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মানসিক ও পারিবারিক অশান্তির কারণে তিনি স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ করতে চান।
সিসিকের একটি সূত্র জানায়, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হয়। কিন্তু, দু’পক্ষের লোকজন শুনানীতে হাজির করা যায় না। এ কারণে অনেক সময় বাধ্য হয়ে তাদেরকে একতরফা শুনানী করতে হয়। সিসিক সূত্র জানায়, নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপস করছেন না। বরং অশান্তি এড়াতে তারা বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করছেন।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান (সহযোগী অধ্যাপক) এবং ব্রেইন ও মাইন্ড স্পেশালিস্ট ডা: আর কে এস রয়েল জানান, আধুনিক লাইফ স্টাইল এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতাই মূলত বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য দায়ী।
তিনি জানান, নানা কারণে মানুষের সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে নেমে আসছে হতাশা। তিনি জানান, শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য (ডমিনেন্স) বাড়ছে। যুক্তরাজ্যে অনেক বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে।
যুক্তরাজ্যের সাথে অ্যাটাচমেন্টের কারণে সিলেটেও এর প্রভাব পড়ছে । বিবাহ বিচ্ছেদ রোধে পারিবারিক শিক্ষা বিস্তারের ওপর জোর দেন এ চিকিৎসক। কারিকুলামে পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক দক্ষতার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ তাঁর।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম জানান, সিলেটে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাবার বিষয়টি আসলেও চিন্তার। তিনি বলেন, সমাজ এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, সেই সাথে আমাদের ধ্যান ধারণা মূল্যবোধেও আসছে পরিবর্তন।
সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন পরিবার এখন আর সেভাবে সামাজিক সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমরা এখন অতি মাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক। সেই সাথে সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে দ্রুত গতিতে। প্রযুক্তির অপব্যবহার, বিদেশি চ্যানেলের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, ধর্মীয় মুল্যবোধ কমে যাওয়া, পারস্পরিক সমঝোতা তথা শ্রদ্ধাবোধের অভাব, চিন্তা চেতনা মতের অমিল এসব বিষয়ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এক সময় সিলেটের সামাজিক বন্ধন ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু, নানা কারণে এ বন্ধনে ছেদ পড়ছে। সিটি কর্পোরেশনে প্রতিদিন বিচ্ছেদের অনেক আবেদন পড়ছে। ছয় মাস কিংবা এক বছর থেকে শুরু করে ২৭ বছরের সংসারের ডিভোর্সের আবেদন পড়ছে।
সিলেটে নারীদের বিচ্ছেদের আবেদন বৃদ্ধির বিষয়টিকে উদ্বেগজনক হিসাবে আখ্যায়িত করে মেয়র বলেন, এ অঞ্চলের বাসিন্দা হিসাবে এটা আমাদেরকে ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে। একটি পরিবার ভেঙ্গে গেলে পুরো পরিবারে এর প্রভাব পড়ে-এমন মন্তব্য করে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বিষয়টির প্রতি সবার নজর দেয়া উচিত। -সিলেটের ডাক