দুরুদুরু বক্ষ…
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুন ২০১৯, ১:১৮ পূর্বাহ্ণড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
জুন মাসের ১৩ তারিখ এই বছরের বাজেট ঘোষণা করার দিন। সেই হিসেবে যখন আমার এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার কথা তার আগেই আমাদের বাজেটটি সবার জানা হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে দেশের বাইরে বসে যখন আমি এই লেখাটি লিখছি, তখন অবশ্য আমি বাজেট সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না।
প্রতিবছরই আমাদের বাজেট বেড়ে যাচ্ছে দেখে বড় ভালো লাগে। প্রতিবছরই আমি বাজেট নিয়ে একধরনের স্বপ্ন দেখি, আমার স্বপ্নটা অবশ্য শিক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে। প্রতিবছরই ভাবি এই বছর নিশ্চয়ই শিক্ষার জন্য একটা সম্মানজনক বরাদ্দ দেওয়া হবে। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। এ বছর শিক্ষা খাতে কত বরাদ্দ রাখা হয়েছে জানি না। কিন্তু অতীতে আমরা দেখেছি আমাদের বাজেট কমতে কমতে জিডিপির ২.২ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এটি কিন্তু শুধু দুঃখের ব্যাপার ছিল না, এটি আমাদের জন্য একটি লজ্জার ব্যাপারও ছিল। যারা আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না তাদের বলব, উইকিপিডিয়াতে গিয়ে কোন দেশ শিক্ষা খাতের জন্য কত টাকা খরচ করে সেটা একবার নিজের চোখে দেখতে। আমি নিশ্চিত তারা অবাক হয়ে দেখবে সারা পৃথিবীতে যে দেশগুলো শিক্ষার পেছনে সবচেয়ে কম খরচ করে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।
আমাদের থেকে কম খরচ করে যে দেশগুলো তাদের মধ্যে রয়েছে সুদান (২.০ শতাংশ) কিংবা সাউথ সুদানের (১.৮ শতাংশ) মতো দেশ। সারা পৃথিবীর উন্নয়নের মডেল হয়ে আমাদের যদি সুদান কিংবা সাউথ সুদানের মতো অকার্যকর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সঙ্গে তুলনা করে শান্তি পেতে হয়, তাহলে তার থেকে বড় লজ্জার কথা আর কী হতে পারে?
আমাদের পাশাপাশি সব দেশ শিক্ষা খাতে আমাদের চেয়ে বেশি খরচ করে। ভারত খরচ করে জিডিপির ৩.৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৩.৫ শতাংশ। পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রটিকে আমি আজকাল হিসাবের মাঝেই আনতে রাজি না, তারা পর্যন্ত জিডিপির ২.৮ শতাংশ খরচ করে। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান তাদের জিডিপির ৩.১ শতাংশ লেখাপড়ার পেছনে খরচ করে। ফিলিস্তিন এখন পর্যন্ত একটি স্বাধীন দেশই হতে পারেনি। তারা পর্যন্ত খরচ করে জিডিপির ৫.৭ শতাংশ।
একেবারে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ কিউবার কথা শুনলে, তারা খরচ করে জিডিপির ১২.৯ শতাংশ! আর সারা পৃথিবীর উন্নয়নের মডেল হয়ে আমরা এত দিন খরচ করে এসেছি জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ। সারা পৃথিবীর সামনে যদি লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা হয়, তাহলে কী দোষ দেওয়া যায়? শিক্ষার জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ না করে আমরা ছেলে-মেয়েদের ঠিক করে লেখাপড়া করাতে পারছি না বলে লজ্জা নয়, জাতি হিসেবে লেখাপড়াকে আমরা কোনো গুরুত্ব দিই না বলে লজ্জা।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশের মানুষের অভিযোগের কোনো শেষ নেই। আমিও মাঝে মাঝে দুঃখ করি, লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলি কিন্তু কখনো অভিযোগ করি না। কোন মুখে অভিযোগ করব? এত কম টাকা খরচ করে পৃথিবীর আর কোন দেশ এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে এত বেশি লেখাপড়া করাতে পেরেছে।
লেখাপড়ার মান যদি বাড়াতে চাই, তাহলে তার জন্য টাকা খরচ করতে হবে। যদি এর পেছনে টাকা খরচ না করে শুধু অভিযোগ করে যাই এবং সেই অভিযোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জোড়াতালি দিয়ে একটা সমাধান খুঁজে নিই, তাহলে কোনো দিন শিক্ষার মানের উন্নতি হবে না। বিষয়টি যে কেউ জানে না তা নয়। আমি নিজের কানে আমাদের আগের অর্থমন্ত্রীকে দুঃখ করে বলতে শুনেছি, দেশের শিক্ষার জন্য যত টাকার দরকার এখন বাজেটে তার মাত্র ৩ শতাংশের ১ শতাংশ রাখা হচ্ছে।
(কথাটি এক শ ভাগ সত্যি, বাংলাদেশ ডাকার সম্মেলনে সারা পৃথিবীর সামনে অঙ্গীকার করে এসেছিল যে তারা জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষার পেছনে খরচ করবে।) যদি দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা এটা জানেন, তাহলে কেন আমরা শিক্ষা খাতে টাকা পাই না? সারা পৃথিবীর সব গুণীজন, সব শিক্ষাবিদ, সব অর্থনীতিবিদ জোর গলায় বলে থাকেন শিক্ষা খাতে টাকা খরচ আসলে ‘খরচ’ নয়, এটি হচ্ছে ‘বিনিয়োগ’। শিক্ষার জন্য যদি এক টাকাও খরচ করা হয় সেই একটি টাকাও কিন্তু কোথাও না কোথায় কাজে লাগে, কখনোই সেই টাকা অপচয় হয় না। তাহলে শিক্ষার জন্য টাকা খরচ করতে আমাদের ভয় কোথায়?
২.
এ বছর শিক্ষা খাতে কত বরাদ্দ রাখা হয়েছে আমরা এখনো জানি না। যদি সত্যি সত্যি এ বছর আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়ে থাকে, শিক্ষা খাতে আমরা একটা সম্মানজনক বরাদ্দ পেয়ে থাকি, তাহলে আমরা কী কী করতে পারি? সেই স্বপ্নের কথা বলে শেষ করা যাবে না, আপাতত শুধু শিক্ষকদের কথা বলি।
সংবাদপত্রে আমরা যেসব খবর দেখি তার মাঝে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক খবর কী হতে পারে? আমার কাছে মনে হয় সেটি হচ্ছে একটুখানি বেতন-ভাতা, একটুখানি নিরাপত্তা ও একটুখানি সম্মানের জন্য শিক্ষকদের আন্দোলন। (না, আমি মোটেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা বলছি না, আমলাদের মতো এতটা না হলেও তাঁরা যথেষ্ট ক্ষমতাবান। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনী প্যানেল নিয়ে কথা বলার জন্য তাঁরা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
আমি স্কুল শিক্ষকদের কথা বলছি।) আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে অনশন, আমরা সব সময়ই দেখি শিক্ষকরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। সেই অনশনের কী ফল হয়? অনশনের পর শিক্ষকরা নিজের জায়গায় ফিরে যান। এভাবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে নিজেদের পরিবার-পরিজন কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে তাদের মুখ দেখাতে কেমন লাগে কে জানে!
যদি শিক্ষা খাতে এবারই আমরা যথেষ্ট টাকা পেয়ে যাই, তাহলে কি আমরা দেশের সব স্কুলের অবকাঠামো ঠিক করে যোগ্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া শুরু করতে পারি না? আমরা আসলে এটাকে খুব জরুরি মনে করি না; ধরেই নিয়েছি স্কুল শিক্ষকের মান-মর্যাদা জীবন খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক।
দেশের বড় বড় জায়গায় ভালো কিছু স্কুল থাকবে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ছেলে-মেয়েরা সেই খ্যাতনামা স্কুলগুলোয় লেখাপড়া করবে। আর দেশের আনাচকানাচের স্কুলগুলো ধুঁকে ধুঁকে কোনোভাবে টিকে থাকবে এবং সেই স্কুলগুলোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে কিভাবে রসাতলে গেছে, সেটি বর্ণনা করে হতাশায় মাথা নাড়বে।
খুব ভালো স্কুল বিল্ডিং, সুন্দর ক্লাসরুম, চমৎকার লাইব্রেরি, আধুনিক ল্যাবরেটরি আর বিশাল খেলার মাঠ থাকলেই যে সেখানে খুব ভালো লেখাপড়া হবে সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ভালো অবকাঠামো অবশ্যই দরকার কিন্তু সেটা সব কিছু নয়। ভালো লেখাপড়ার জন্য আরো তিনটি বিষয় দরকার, সেগুলো হচ্ছে ভালো পাঠ্য বই, ভালো পরীক্ষা পদ্ধতি এবং ভালো শিক্ষক।
ভালো পাঠ্য বই হলে ছেলে-মেয়েরা নিজেরা অনেক কিছু শিখে নিতে পারে, তাদের প্রাইভেট টিউটর আর কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হয় না। সবাই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চায়, তাই পরীক্ষা পদ্ধতি ভালো হলে যারা ভালো জানে, শুধু তারাই ভালো নম্বর পাবে এবং ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই মুখস্থ করে শর্টকাট পদ্ধতির জন্য না গিয়ে সত্যিকারের লেখাপড়া করবে। ভালো পাঠ্য বই আর ভালো পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য যে খুব বেশি বাজেট দরকার তা নয়, তার জন্য দরকার সদিচ্ছা আর সুন্দর একটা পরিকল্পনার।
এ দেশে এর যে বড় ঘাটতি আছে সেটা মনে হয় না কিন্তু তার পরও কেন এ দেশের ছেলে-মেয়েরা ভালো পাঠ্য বই আর ভালো পরীক্ষা পদ্ধতি পাচ্ছে না, সেটা বুঝতে পারি না। (যেমন—আমি সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির নানা রকম সমালোচনা শুনি, শিক্ষকরা যেহেতু মানসম্পন্ন প্রশ্ন করতে পারেন না, বিশাল প্রশ্নের একটা ডাটা বেইস তৈরি করে রাতারাতি এ সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া যায়। সেটা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে কিন্তু কার্যকর হতে দেখছি না।)
ভালো পাঠ্য বই আর ভালো পরীক্ষা পদ্ধতি হয়তো সহজেই পাওয়া যাবে, তবে ভালো শিক্ষক পাওয়া কিন্তু এত সহজ নয়। এর জন্য আমাদের টাকা খরচ করতে হবে। আমি সব সময়ই কল্পনা করি শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা বেতন স্কেল হবে এবং সেই স্কেলটি হবে খুব আকর্ষণীয় একটা স্কেল।
সেটি এমন আকর্ষণীয় হবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল শিক্ষকদের এত রকম সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক সম্মান দেওয়া হবে যে একজন তরুণ শিক্ষার্থী পাস করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতোই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। জীবনটাকে উপভোগ করা যদি বেঁচে থাকার সার্থকতা হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষক হওয়ার মতো আনন্দ আর কিসে আছে?
এ সবই কি খুব অবাস্তব কল্পনা? আমার তো মনে হয় না।এখন দুরুদুুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি, এবারের বাজেটে কি শিক্ষা খাতে একটা সম্মানজনক বরাদ্দ রাখা হয়েছে?
লেখক: কথা সাহিত্যিক।