রচিত হোক নতুন রূপকথা
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০১৯, ১০:৩১ অপরাহ্ণগ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে শীতের দেশ থেকে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ক্রিকেট মহোৎসব। ষষ্ঠবারের মতো আমরাও খেলব এই বিশ্ব আসরে। টিমে ১৫ জন এবং সঙ্গে ১৬ কোটি মানুষ। প্রকৃতির গরমে ক্রিকেটের উত্তাপ মিলেমিশে একাকার। কোনো অনুষঙ্গ পেলেই যেখানে উৎসবের রঙ দিতে পছন্দ করে বাঙালি, সেখানে বিশ্বকাপ ক্রিকেট হলে তো কথাই নেই। অনেক সাধনায়, অনেক ভালোবাসায় পাওয়া আমাদের এই গর্বের ধন ক্রিকেট, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের বড় বিজ্ঞাপন। দ্রুত উপরে উঠছে উত্তেজনার পারদ। নানা সামাজিক অস্থিরতা ও সংকট ছাপিয়ে দেশ এখন ক্রিকেটমুখী। শুনেছি ইফতারের আগে বা তারাবির পরে মোনাজাতেও এখন অনেকে টাইগারদের সাফল্য কামনা করছেন। ঈদের নতুন জামার সঙ্গে সংগ্রহ করে ফেলেছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি।
সভা, সেমিনার, চা-খানার আড্ডা কিংবা বিপণিবিতানেও আলোচনার প্রধান বিষয় ক্রিকেট। ফুটবল বিশ্বকাপে যখন দেশবাসীর মধ্যে থাকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানিকে সমর্থন করার মতো নানা বিভাজন; সেখানে এখন আমরা এক সুতোয় গাঁথা- বাংলাদেশ। আমাদের একটাই চিন্তা, একটাই দল। আমরা চাই, লাল-সবুজের জয়; বায়ান্ন-একাত্তরে গর্জে ওঠা বাঙালির জয়।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন খেলা ক্রিকেট। তবে এ দেশে বা এ অঞ্চলে খেলাটির ইতিহাস কিন্তু খুব পুরনো নয়।
১৭৯২ সালে ব্রিটিশদের হাত ধরে বঙ্গে ক্রিকেট এলেও সেটা ছিল পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক। ইতিহাস বলছে, ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ক্রিকেটের ছোঁয়া লাগে, তবে সেটা ছিল উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এ দেশে ক্রিকেট গতি পায় স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর ১৯৯৯ সাল থেকেই বিশ্বকাপে খেলছে বাংলাদেশ। শুরুটা ইংল্যান্ড থেকেই। প্রথম বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় চমক ছিল ৬২ রানে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়া। তার পর থেকেই টাইগাররা বিশ্বকাপে কোনো না কোনো চমক দেখাচ্ছে। ২০০৭ সালে ক্যারিবীয় বিশ্বকাপে প্রথমে ভারত ও পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেওয়া বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছিল শেষ আটে। অল্পদিনে এই উত্তরণ বিস্ময়কর। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের প্রত্যাশাও তাই বেড়েছে অনেক।
‘এবারের বিশ্বকাপে আপনার কাছে টপ ফেভারিট কে?’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রশ্নটি ছুড়ে দিলে আমার তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল- ‘বাংলাদেশ’।
মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করল ওরা। একজন তো সরাসরি বলেই ফেলল, ‘কী বলেন, এও কি সম্ভব!’
আমি ওদেরকে সেই পুরনো গল্পটিই বলেছি- স্বপ্ন যখন দেখবে, তখন আকাশ ছোঁয়ার মতো বড় স্বপ্নই দেখতে হবে। তবে বিশ্বকাপ জয়ের এই স্বপ্নটি কিন্তু অনেকটাই এখন আমাদের নাগালে। যে কোনো সময়ই রচিত হবে সেই কাঙ্ক্ষিত রূপকথা। আশ্চর্য না হয়ে আমাদের সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে।
ছিয়ান্নব্বইয়ের বিশ্বকাপজয়ী মুখগুলোর কথা আমি সেদিন শিক্ষার্থীদের স্মরণ করতে বলেছি। ওইবার নিশ্চয় আগে থেকে কেউ ভাবেনি শ্রীলংকা ছিনিয়ে নেবে ট্রফি। আমরা যদি রানাতুঙ্গা, ডি সিলভা, জয়সুরিয়া, কালুভিথারানা, মহানামা, মুরালিধরন, গুরুসিনহাদের চেহারাগুলো একটু মনে করার চেষ্টা করি আর সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখি আমাদের মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লার মুখ; তাহলে নিজের কাছেই উত্তরটা পেয়ে যাব। পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে তো খুব বেশি বেখাপ্পা লাগার কথা না। মাশরাফিসহ আমাদের অভিজ্ঞ পাঁচজন ক্রিকেটার আছেন, যারা কমপক্ষে চারবার করে বিশ্বকাপ খেলেছেন। আমাদের এবারকার যে ব্যাটিং লাইনআপ, সেটা খুব কম দলেরই আছে। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ- স্তম্ভ হয়ে রয়েছেন আমাদের চারজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। বিশ্বকাপের আগে সবাই আছেন ফুল ফর্মে, খেলছেন ভালো। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মারকুটে তরুণরাও। সাকিব আবার তার বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের স্থানটি দখলে নিয়েছেন। আমাদের মাশরাফি বিন মুর্তজা দেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক, পুরো টিমের চেহারা বদলে দেওয়ার মতো জাদুর কাঠি আছে যার কাছে। ফিনিক্স পাখির মতো যিনি বারবার জন্ম নিয়েছেন। অস্ত্রোপচারে, অস্ত্রোপচারে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মেন্টর হয়ে আছেন তরুণ সহযাত্রীদের। তাকে কীভাবে এবার নিরাশ করবে ক্রিকেট? বলা হচ্ছে, এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। এই যদি হয়, আমরা তো চাইব বাংলাদেশের একটি বড় জয় সঙ্গে নিয়েই ইতিহাস হবেন তিনি। না হলে যে তার প্রতি বড় অবিচার হয়ে যাবে।
অল্প কিছুদিন আগেই আমরা উদযাপন করেছি আরেকটি বিজয়। আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথম শিরোপার অধিকারী হয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো মাশরাফিদের উদযাপনে শোভা পেয়েছে ‘চ্যাম্পিয়ন’ লেখা ট্রফি। এবার তাই ফেভারিট হয়েই আমরা ইংল্যান্ডের মাঠে নামছি। মাশরাফিদের হাতে সেখানে নিশ্চয় রচিত হবে সেই রূপকথা, যার জন্য আমরা এতকাল ধরে মুখিয়ে আছি।
বিশ্বকাপের কারণে আমাদের সোনার ছেলেরা এবার ঈদ করবে দেশের বাইরে। আর দেশে থেকে আমরা একই সঙ্গে উদযাপন করব ঈদ এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেট। উদযাপন এবার ভালোই হবে বলা যায়। তবে আমরা এও জানি, ক্রিকেট একটি অনিশ্চয়তার খেলা। এখানে ঘটতে পারে যে কোনো অঘটনই। কল্লোল যুগের কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন- ‘মায়ার খেলা ক্রিকেট’। সেই মায়া যে কত অনিশ্চয়তার, সেটা ক্রিকেট অনুরাগীমাত্রই জানেন। তবে কোনো অনিশ্চয়তা নয়, আমরা অধীর আগ্রহে শুধু অপেক্ষা করতে চাই বিজয়ের। বারবার লিখতে চাই আমাদের মাশরাফি, আমাদের সাকিব, তামিম, মুশফিকের মহাকাব্যিক কীর্তিগাথা। জয়তু, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। জয়তু, টাইগার বাহিনী।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সমকাল।