রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শাকুর মজিদের প্রথম লেখা ‘রং তুলীর রবীন্দ্রনাথ’
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মে ২০১৯, ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণবিয়ানীবাজারবার্তা২৪.কম।। ১৯৮৩ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন “ফৌজিয়ান” এ ‘রং তুলীর রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ক্যাডেট শাকুর মজিদের এটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর প্রথম লিখা।
বুধবার রাতে শাকুর মজিদ ফেসবুকে ঐ লেখাসহ প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। বিয়ানীবাজারবার্তা২৪.কম’র পাঠকদের জন্য তা হুবহূ তুলে ধরা হলো-
শাকুর মজিদ লিখেন, “রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা। প্রকাশ – ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ বার্ষিক ম্যাগাজিন, “ফৌজিয়ান”, ১৯৮৩ সালে”
রং তুলীর রবীন্দ্রনাথ
কেডেট শাকুর
একাদশ মান
‘নানা জিনিসকে দেখিবার যে দৃষ্টি, সে দৃষ্টি যেন আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল্ …তুলী দিয়া যদি ছবি আঁকিতে পারিতাম তবে পত্রের উপর রেখা ও রং দিয়া উতলা মনের দৃষ্টি ও সৃষ্টিকে বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতাম। কিন্তু সে উপায় আমার হাতে ছিল না। ছিল কেবল কথা ও ছন্দ। কিন্তু কথার তুলীতে তখন স্পষ্ট রেখার টান দিতে শিখি নাই। তাই কেবলই রং ছড়াইয়া পড়িত।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ উক্তিটি করেছিলেন। কবি যখন দোতলার জানালার কাছে বসে লোকালয়ের দৃশ্য দেখতেন তাঁর ভারী আনন্দ লাগতো, মনে হতো সবই যেন গল্পময়Ñসবই যেন ছবি। একদিন কবির সে সাধ পুরলো, শব্দের বন্ধন মুক্ত কওে রেখার বন্ধনে আবদ্ধ হলেন কবি।
যে কবির মানস চক্ষু সর্বদা কবিতা লেখায় মগ্ন থাকতো সে কবির আবার ছবি আঁকার আগ্রহ এলো কোথা থেকে? এ ধরনের একটা প্রশ্নের জবাবে কবি বলেছিলেন, ‘আমি যখন কবিতা আর চিঠি লিখতুম, অপছন্দ লেখাগুলো কেটে ফেলতুম। সেই কাটাকাটিগুলো রূপ চাইত, তারা হতে চাইতো, জন্ম নিতে চাইতো, তাদের সে ইচ্ছা আমি অগ্রাহ্য করতে পারতুম না। পড়ে থাকতো লেখা। সে কাটাকুটিগুলো রূপে ফলাতুম, পারতুম না তাদের প্রেতলোকে ফেলে রাখতে। এভাবে আমার ছবি আঁকা শুরু।’
সত্যিকথা বলতে কি ১৯২৪ সালের আগে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাংকনে কোন সাড়া দেখা যায় না। একবার তিনি যখন আমেরিকায় ছিলেন তখন খুব বেশি বেশি চিঠি লিখতেন। কাটাকুটিগুলোকে তিনি এমন পরিমার্জিত রূপ দিতেন তাতে কোনটা হয়ে যেত পাখী, কোনটা সাপ, কোনটা বা জীব-জন্তু। আবার পান্ডুলিপি সংশোধন করতে যেয়ে হিজিবিজি দাগ টানার মধ্যে অবচেতনভাবে হলেও একটা সম্পর্ক একটা সমন্বয় কবি চোখকে এড়াতে পারেনি। ধরা পড়েছে তার রূপ দক্ষ চোখে রেখার জগতের ছন্দ।
রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার কোন ধারণা ছিল না। হঠাৎ একদিন খেয়ালের বশে এলোমেলো ছবি আঁকলেন। পঁচিশ থেকে সাতষট্টি বৎসর কবি ছবি আঁকার নানা প্রয়াস করেছেন যার প্রমাণ পত্রাবলী এবং পান্ডুলিপিতে। বহুদনি ধরে নিজের লেখার কাটাকুটির উপরে কলম চালিয়ে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে রেখা আয়ত্ব করা সম্ভব হয়েছিল। পরে রং এর ব্যবহার করেছেন নানা পরীক্ষার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ উইলিয়ামে ব্লেকের মত কোন আর্টস স্কুলে পড়েনি। তাই তার ছবিতে শারীরবৃত্তি-সংস্থান কিংবা ব্যাকরণের সঙ্গতি অনুপস্থিত। কিন্তু প্রখর বর্ণরুচি তার সঙ্গতি এনেছে।
রবীন্দ্র চিত্রে এক অবচেতন মনের সৃষ্ট পরাবাস্তব জগতের স্বরূপের উন্মোচন ঘটেছে স্তরে স্তরে। কখনো ভয়ংকর অর্থহীন বাস্তবে অনুপস্থিত জন্তু জানোয়ারের চিত্রে, কখনো-বা বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি চিত্রনে। কথার বাঁধনে যেখানে মনের সব কিছুকে উজাড় করে দিতে পারে না সেই দ্বন্দ্ব সংঘাত ডানে, বায়ে, নিন্দার পংক, মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ আপন খেয়াতরীকে মুক্তি দিলেন রেখার প্রগলভতায়।
শিল্পকলা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল, ‘শিল্প আমার প্রকাশ। শিল্পী আত্মা নিজেকেই প্রকাশ করেন শিল্পের মাধ্যমে। এ তাঁর আত্মার আনন্দ প্রকাশ। শিল্প হচ্ছে প্রত্যক্ষ অনুভূতি।
রেখার বন্ধনে কবি মন যখন ঘেরা, কবিতার সাধনা যখন রং তুলী আর রেখায় মেতে উঠেছে তখন রেখো নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে কবি লিখেন,
‘রেখা অপ্রগলভা, অর্থহীনা
তার সংগে আমার যে ব্যবহার, সবই নিরর্থক।
কথা আমাকে প্রশ্রয় দেয় না, তার কঠিন শাসন,
রেখা আমার যথেচ্ছাচারে হাসে,
তর্জনী তোলে না।’
রবীন্দ্র প্রতিভার আলোচনা করলে তাঁর চিত্রকে কোনমতেই বাদ দেয়া যাবে না। তবে সেটা হবে অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্র চিত্রাবলীতে মানবমনের অপর দিকটি প্রকাশ পেয়েছে, অবচেতনের উৎস থেকে ছবিগুলো রেখার ঝরনার মত উৎসারিত হয়েছে- সে জগতে সুষমা নেই, শাস্তি নেই- সামঞ্জস্য নেই, কিন্তু শিল্পলোকের শাসন আছে।
রবীন্দ্রনাথের চিত্র শিল্পের উপর প্রথম প্রদর্শনী হয় প্যারিসে ও বার্লিনে ১৯৩০ সালে। পরে অবশ্য বার্মিংহাম, নিউ ইয়র্ক, ভারতের কলকাতায় (১৯৩২) ও বোম্বাই (১৯৩৩)।
রবীন্দ্র চিত্রে কোন নির্দিষ্ট জাতীয়তা ছিল না। তাঁর ছবিতে ছিল সার্বজনীন সমাজের হাসিকান্নার ছায়া। তাঁর ছবি কোন ভূগোল মানতো না, মানতো না কোন পিছুটান। ১৯৩০ সালের আগস্টে তিনি শ্রীযুক্তা নির্মলকুমারী মহলানবীশকে পত্রে লিখেন, ‘ছবি যখন আঁকি তখন রেখা বলো, রং বলো, কোন বিশেষ প্রদেশের পরিচয় নিয়ে আসে না। অতএম, এ জিনিসটাকে যারা পছন্দ করে তাদেরই আমি বাঙ্গলী বলি, এটা আপন হ’তেই বাঙ্গালীর জিনিস নয়্ আমি সান পরিমাণ ইউরোপেরও।’
রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেন তেষট্টি বছর বয়সে ১৯২৪ সাল থেকে। আর যখন সত্তর বছর বয়স ছিল তখন একবার লিখেছিলেন, ‘আমার বয়স সত্তর হয়ে গেছে। ছবি কোনদিন আঁকিনিÑ আঁকবো বলে স্বপ্নেও বিশ্বাস করিনি। হঠাৎ বছর দুই তিনেকের মধ্যে হু হু করে এঁকে ফেললুম।’ রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন সকালবেলা কিছু না খেয়েই একটা ছবি আঁকতেন এটা তার এক প্রকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল। ছবির প্রতি ঝোঁক নিয়ে একবার খবর হচ্ছে ছবি আঁকা। রেখার মায়াজালে আমার সমস্ত মন জড়িয়ে আছে। অকালে অপরিচিতার প্রতি পক্ষপাতে কবিতা একেবারে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। কোনকালে যে কবিতা লিখতুম, সেকথা ভুলে গেছি।’
রবীন্দ্রনাথ হাজার তিনেক ছবি এঁকেছেন। তার ছবিগুলোকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমত: বাস্তবানুগ চিত্রÑ এ’তে মানুষের বা জীবজন্তুর প্রতি কৃতি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত: পরাবাস্তব অভিব্যক্তিবাদদীÑ এ’তে কিন্তুতকিমাকার জীবজন্তুর ছবি, অস্বাভাবিক মুখাবয়বÑ ইত্যাদির চিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। তৃতীয়ত: ছিল নির্বস্তব চিত্রÑ যেটা শুধু রেখা দিয়ে অংক