শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর এ মেরুদণ্ডকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন শিক্ষক সমাজ। এ যুগে শিক্ষকদের সম্মান কিংবা আত্মমর্যাদা নিয়ে নানাজন নানাভাবে কথা বলেন। বাস্তবিক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা যেমন নমস্যতুল্য, ক্ষেত্রবিশেষ অবজ্ঞাও করা হয়। প্রতিনিয়ত এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। তবে, সুশিক্ষা এবং আদর্শ শিক্ষক একই সূত্রে গাঁথা। বাস্তবে এ দু’য়ের সম্মিলন ঘটলে বিনির্মাণ হবে আদর্শ সমাজ, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এর ফলে সমাজে থাকবে না কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা হিংসা-বিদ্বেষ। বরং নতুন প্রজন্মের মধ্যে রচিত হবে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বন্ধন। যেমনটা আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যাশা করি।
আরেকটি কথা আমরা প্রায়শঃ বলে থাকি- ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়। আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন, চিরন্তন এ সত্য কথার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো মোটেও কষ্টসাধ্য নয়। লক্ষ্য স্থির কিংবা মহৎ হলে যেকোনো কাজে হাজারো বাধা-বিপত্তি, শত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তা বাস্তবায়ন করার নজির আছে। এক্ষেত্রে কর্ম বুঝে হয়তো সময়, অর্থ এবং মানদন্ডে কিছুটা হেরফের হতে পারে। মানবিক হৃদয়ের চ্যালেঞ্জ নেয়া এমন অসংখ্য মানুষের ঋদ্ধ গল্পের ভুরি ভুরি উদাহরণ আমাদের সবার সামনে রয়েছে।
তাদেরই একজন জলঢুপ মাস্টার বাড়ির সন্তান ফয়সল আহমদ রুহেল। তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ড, চিন্তা, চেতনা ও মননে শিক্ষার ছাপ অবলীলায় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। তিনি পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে গ্রামীণ জীবনে কাটানো নানা রঙের সুখ-স্মৃতির ফেলে আসা দিনগুলোর কথা তিনি ভুলে যাননি। সময় সুযোগ পেলেই প্রিয় মাতৃভূমির যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে তিনি স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে আদর্শ শিক্ষাগুরুদের খোঁজখবর রাখা এবং কিভাবে তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা যায় এ বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত থাকেন প্রবাসী ফয়সল আহমদ রুহেল। কারণ তাঁর পিতাও একজন শিক্ষক ছিলেন। তাদের অবসর জীবন কিভাবে কাটে তার চাক্ষুস সাক্ষী তিনি নিজেই।
বিয়ানীবাজার উপজেলার জলঢুপ পাড়িয়াবহর গ্রামের ‘মাস্টার বাড়ি’তে ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ফয়সল আহমদ রুহেল। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তার পিতা তজম্মুল আলী ও মাতা ফয়জুন নেছা। তার মা-বাবা দু’জনই ইহজগতে নেই, তাঁরা এখন পরকালের বাসিন্দা (আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতবাসী করুন-আমিন)। ফয়সল আহমদের পিতা তজম্মুল আলী ছিলেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক তথা ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি ‘টি.আলী স্যার’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। পিতা পেশাগত কারণে কর্মস্থলে থাকায় মায়ের সান্নিধ্যে কেটেছে ফয়সল আহমদের শিশুকাল। তিনি কালাইউরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাস করেন। পরে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে ভর্তি হন। একই কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৯৩ সালে কৃতিত্বের সাথে বিএ পাস করেন। এ সময়ে পড়ালেখার পাশাপাশি গান ও নাটকে ছিলো তার নেশা। সে সময় তিনি স্কুলভিত্তিক জেলা পর্যায়ে সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেন।
আমরা সবাই জানি এবং সগর্ভে উচ্চারণ করি- সুশিক্ষিত জাতি গঠনে আদর্শ শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণপন চেষ্টা করেন। এজন্য বলা হয়, পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকদের স্থান। এসব কারণে তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানো প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে আমরা ধরে নিই। কিন্তু আমরা ক’জনে শিক্ষকদের অন্তরে লালন কিংবা তাঁদেরকে মূল্যায়নের চেষ্টা করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘যেখানে গুণের সমাদর নেই, সেখানে গুণী জন্মাতে পারে না।’
একটি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে বৈচিত্রতা পরিলক্ষিত হয়। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয়; তেমনিভাবে কাজে-কর্মে, শিক্ষা-দীক্ষা, উৎসাহ-উদ্দীপনা কিংবা উদ্যোগী হওয়ার ক্ষেত্রে সবার মানদণ্ড এক না-ও হতে পারে। এজন্য প্রবাসী ফয়সল আহমদ রুহেল এর চিন্তায় জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় ‘বন্ধু ৮২-৮৭ হোয়াটসআপ গ্রুপ’ গঠন করেন। এর মাধ্যমে তিনি ২ লক্ষাধিক টাকার তহবিল সংগ্রহ করেন। এ ফান্ডে বাংলাদেশের বন্ধুরা আরো অর্ধলক্ষাধিক টাকা যোগ করেন। একপর্যায়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস প্রকোপের সময় চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ১৪ শিক্ষককে সম্মান জানানো হয়। তাঁরা হলেন, জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজির উদ্দিন, প্রধান শিক্ষক মো. আকমল আলী, প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক মো. হারিছ আলী, নৃপেন্দ্র কুমার দাস, রঙ্গ বিহারী দাস, মো. রইছ আলী ও মাওলানা মো. ছরকুম আলীকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়া মঞ্চ থেকে সম্মাননা স্মারক, স্মার্ট ফোন ও উত্তরীয় গ্রহণ করেন সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কবির খান, অদ্বৈত্য কান্ত দাস, মাওলানা মো. মাহমুদুর রহমান, বিধান চন্দ্র দাস, শ্যামা কান্ত দাস ও ঘুঙ্গাদিয়া-বড়দেশ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাহাব উদ্দিন। তাঁরা প্রত্যেকেই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতীতে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মহতি এ অনুষ্ঠানে সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা দিতে পেরেছি বলেই আজ সম্মানীত হয়েছি। জীবনের পড়ন্ত সময়ে এ রকম সম্মান দেশ ও জাতির কাছে নিঃসন্দেহে আমাদেরকে করেছে মহিমান্বিত। প্রকৃত শিক্ষাই হলো, ছোটদের প্রতি আদর ও বড়দের সম্মান জানানো। শিক্ষকরা আরও বলেন, আমাদের সম্মান জানিয়ে ‘৮২-৮৭’ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা যুগ যুগ অমলিন থাকবে। এ সম্মান জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলেও তাঁরা অকপটে স্বীকার করেন। অনুকরণীয় এ ধারা অব্যাহত রাখতে সম্মাননায় ভূষিত শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। সূত্র: দৈনিক সিলেটের ডাক, শেষ পৃষ্ঠা, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১।”
ফয়সল আহমদ রুহেল স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ১৯৯৫ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। সেখানে যাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের সংসার আলোকিত করে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। সংসার জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে তিনি ইংরেজী শিক্ষার বিভিন্ন কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে মাল্টিল্যাংগুয়েজ এডভাইস সার্ভিসে বাঙালি এডভাইস ওয়ারকার হিসেবে ১১ বছর ও বাঙালি ল্যাংগুয়েজ শিক্ষক হিসেবে ১৭ বছর কাজ করেন। তার উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে সাউথ ইস্ট লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির নাম ও ছবি সম্বলিত ‘আওয়ার রুটস’ ডাইরেক্টরী। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এটি বাঙালির দলিল হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে লন্ডনে বসবাস করলেও অর্থনৈতিকভাবে বিত্ত বৈভবের মালিক হতে পারেননি ফয়ছল আহমদ। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় তৃপ্তির জায়গা হচ্ছে সন্তানদের সুশিক্ষিত করতে পেরেছেন। তিনি মনে করেন, ছেলে মেয়েদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারাটা তার জীবনের বড় সার্থকতা। তার স্ত্রী রি-জেনারেশন এন্ড ডেভোলপমেন্ট, বড় মেয়ে মেডিসিনে মাস্টার্স, মেঝ মেয়ে একচুয়াল সায়েন্স এবং একমাত্র ছেলে অর্থনীনিতে গ্রেজুয়েশন করে বর্তমানে প্রত্যেকেই স্বীয় পেশায় কর্মরত।
ফয়সল আহমদ রুহেলের পিতা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছর মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রিয় স্যারের মৃত্যুর পর তার ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীরা ২০১৯ সালে হবিগঞ্জ সরকারী স্কুলের সামনের রাস্তার নামকরণ করেন ‘টি.আলী স্যার সড়ক’। প্রয়াত এ শিক্ষকের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘টি.আলী স্যার স্মারকগ্রন্থ’। ২০১৯ সালে এ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ‘শিক্ষাব্রতী মহান পুরুষ’ নামে। পিতার প্রতি প্রাক্তন ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও মূল্যায়ন দেখে তিনি সত্যিই অভিভূত হন। শিক্ষক পিতার মৃত্যুর পর প্রবাসী ফয়সল আহমদ রুহেল পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ‘টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন’। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে গড়ে তুলেন একটি দৃষ্টিনন্দন পাকা লাইব্রেরী ভবন। এখন সময়ের পরিক্রমায় বিয়ানীবাজার অঞ্চলে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে টি.আলী মেমোরিয়াল লাইব্রেরি অগ্রসরমান পাঠকের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
শিক্ষকদের জন্য অগাধ দরদ রয়েছে প্রবাসী রুহেলের। তাঁদের জন্য সর্বদা তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। এজন্য তিনি ২০১৯ সালে হবিগঞ্জ ও সিলেটের দুইজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তারকে সম্মাননা প্রদান করেন। এছাড়া আগামী বছরের শুরুতেই ‘টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন’ এর মাধ্যমে সিলেট জেলার ২৪ জন অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে ভূষিত করা হবে। এরমধ্যে অস্বচ্ছল ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হবে। পাশাপাশি এসব শিক্ষকদের আত্মজীবনী নিয়ে প্রকাশিত হবে সমৃদ্ধ গ্রন্থ। ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও প্রবাসী সাংবাদিক ফয়সল আহমদ রুহেল ইতিমধ্যে শিক্ষকদের জীবনী লেখার কাজ শেষ করেছেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ফয়সল আহমদ রুহেলকে এখনো আমি সরাসরি সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নত সুযোগ সুবিধা নিয়ে প্রতিনিয়ত তার সাথে কথাবার্তা হয়। এ থেকে বুঝতে পেরেছি- শিক্ষক সমাজ এবং মানবতার কল্যাণে তার কাজ করার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। সম্প্রতি কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর কিভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হন তা দেখেছি। এমন বেদনাবিধূর অনুভূতি থেকে আমি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করলে আনন্দ পাই। তিনি সবাইকে আদর্শ শিক্ষকদের পূজারি হওয়ার অনুরোধ করেন।’
আজ ৩১ ডিসেম্বর শুক্রবার ফয়সল আহমদ রুহেল এর ৫২তম জন্মদিন। সুখ, শান্তি আর শিক্ষাব্রতী মানুষ হিসেবে তিনি এ ধরণীতে বেঁচে থাকুন চিরকাল। জন্মদিনের বিশেষ এ ক্ষণে মহান আল্লাহর দরবারে আমার এই প্রার্থনা। কেটে গেছে করোনা ভাইরাস, কাটবে ওমিক্রণ। সে পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করুন।
২৯ ডিসেম্বর ২০২১