গৃহবধূ রিমার মৃত্যু: প্ররোচিত আত্মহত্যা, না পরিকল্পিত হত্যা?
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুন ২০১৯, ৮:৫০ পূর্বাহ্ণছাদেক আহমদ আজাদ
বিয়ানীবাজারে গৃহবধূ রিমা বেগমের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে। এটি প্ররোচিত আত্মহত্যা, না পরিকল্পিত হত্যা এ নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আবার যে কাঠের বর্গায় রিমা ঝুলেছিল তা অনেকটা ঘুণেধরা। রিমার মা বা ভাই বিশ্বাস করতেই পারছেন না-এটা আত্মহত্যা। তারা রিমার ননদের স্বামী হোসেন আহমদের দিকে নিক্ষেপ করছেন সন্দেহের তীর। মা ও ভাইয়ের দাবি ননদের স্বামী হোসেন, ফুফাতো ভাই নুরুল এবং শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসবে আসল তথ্য।
রিমার শ্বশুর বাড়ির পক্ষ ও বাবার বাড়ি পক্ষের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত রোববার দুপুরে ইবনে সিনা হাসপাতালে রিমা বেগমের রহস্যজনক মৃত্যু নিশ্চিত হয়েই স্ত্রী নিয়ে ননদ জামাই হোসেন আহমদ (৩২) গা-ঢাকা দিয়েছেন। তার সেলফোন কিংবা হোয়াটসআপ, ইমো, ম্যাসেঞ্জার বন্ধ রয়েছে। আবার ফুফাতো ভাই নুরুল হক (৩৫) ঝুলন্ত রিমার দেহ মাটিতে নামিয়েই দ্রুত বাড়ি ত্যাগ করে। শ্বশুর ফলিক মিয়া (৫০) পরিবারে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই জানেন না। জানলে এতদূর হয়তো গড়াতো না বলে তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি। তবে এ ঘটনায় শাশুড়ি ও হোসেনের স্ত্রী ননদ সুহাদার ভূমিকা নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি বিয়ানীবাজার উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের উত্তর চন্দগ্রামে কাতার প্রবাসী চাচাতো ভাই জুবেল আহমদের সাথে রিমা বেগম (২৮) ওরফে বুশরা’র বিয়ে হয়। মুখোমুখি ঘর হওয়াতে উভয় পরিবারের লোকজন প্রথমে এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। পরে আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে দু’পরিবার বিয়েতে সম্মতি প্রকাশ করে। সুখের সংসার গড়ে ছুটি শেষে জুবেল কাতার চলে গেলে তাদের ঘরে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। আফরোজা জান্নাত নুরীর বয়স এখন ১৮ মাস। শ্বশুর-শাশুড়ি ও একমাত্র মেয়ে নুরীকে নিয়ে রিমা বেগমের সুখের সংসার চলছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহত রিমার ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, গত ৩/৪ মাস থেকে রিমা বেগমকে কু-প্রস্তাব দেন তারই ননদজামাই হোসেন আহমদ (৩২)। সে গোলাপগঞ্জ উপজেলার রণকেলী ইয়াগুল গ্রামের শফিকুল ইসলামের পুত্র। অনৈতিক প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান না করায় রিমার এডিটিং করা উলঙ্গ ছবি হোসেন আহমদ তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে প্রেরণ করেন। এরপর ফোন করে জানায়, তার সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত না হলে উলঙ্গ ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবে। এমনকি এ কথা অন্য কাউকে বললে তার ননদকে তালাক দেয়ারও হুমকি দেন। এমনকি সবকিছু ছেড়ে শিশুকন্যা নিয়ে তার সাথে সংসার করার প্রস্তাবও দেয় হোসেন। ননদ জামাইয়ের এসব কথায় রিমা বেগম খুবই ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে পড়েন। এসব বিষয়ে পরিবারের কাউকে না বলে তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে সব কথা খুলে বলেন। কোনো এক সময় তিনি ননদ জামাইয়ের বিষয়টি শাশুড়ি আলেয়া বেগমকে অবহিত করেন। বিষয়টি তিনি প্রবাসী পুত্রকে না শোনানোর জন্য পুত্রবধূকে অনুরোধ করেন।
এ অবস্থায় গত রমজান মাসে স্ত্রী নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসেন হোসেন আহমদ। রাতে শ্বাশুড়ির উপস্থিতিতে হোসেন আহমদ তার কৃতকর্মের জন্য ভাবি রিমার কাছে ক্ষমা চান। বিষয়টি তাৎক্ষণিক রিমা বেগম তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে জানান। এমনকি হোসেন আহমদের সকল কথাবার্তা গর্ভধারিণী মায়ের কাছে খুলে বলেন রিমা বেগম। এসব শুনে মা জয়নব বেগম দু’পরিবারে শান্তি বিরাজমান রাখতে রিমাকে সহ্য করার পরামর্শ দেন।
সরেজমিনে রিমার বাড়ি গিয়ে জানা যায়, জনবসতিপূর্ণ লম্বা বাড়িতে রিমার পিতা ও শ্বশুরের ঘর সামনাসামনি। মধ্যখানে একটি উঠান রয়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দু’দিন পর রিমার ভাইবোন মা’কে নিয়ে নানাবাড়ি বেড়াতে যান। এ সময় রিমাকে সাথে যাওয়ার কথা বলা হলেও তিনি যাননি। এক পর্যায়ে গত রোববার দুপুরে বিশেষ কাজে বাড়িতে ফিরেন রিমার ছোট ভাই সাহেল আহমদ। উঠানে পা রাখতেই হঠাৎ করে বড়বোন রিমার শ্বশুরের (তালই) চিৎকার শুনতে পান। রান্নাঘরে প্রবেশ করে দেখেন টিনের চালের ঘুণেধরা একটি কাঠের বর্গার সাথে উড়না দিয়ে ঝুলানো রয়েছেন তার বোন রিমা বেগম। এ সময় বোনের শ্বশুর ফলিক মিয়া ও তার ভাগ্নে নুরুল হক রান্নাঘরে ছিলেন।
রিমার ছোট ভাই সাহেল আহমদ জানান, ঝুলন্ত অবস্থা থেকে রিমাকে নিচে নামান নুরুল হক ও ছালেহ আহমদ। এরপর প্রায় মৃত রিমাকে নিয়ে রানাপিং রহমানিয়া হাসপাতালে নিয়ে যান সাহেল, প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর, কামরান ও তাদের আম্মা। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার অবস্থা দেখে দ্রুত সিলেট প্রেরণ করেন। এ অবস্থায় নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে রিমা বেগমকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরে স্বজনরা রিমা বেগমের মরদেহ নিয়ে বাড়িতে যান। খবর পেয়ে ঐদিন বিকেলে বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পুলিশ রাতে অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করে। মামলা নং ৯, তারিখ ০৯/০৬/২০১৯ ইংরেজি। ময়নাতদন্তের পর সোমবার বাদ জোহর উত্তর চন্দগ্রাম জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে রিমার মরদেহ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।
এ প্রতিবেদকের সাথে গতকাল শনিবার আলাপকালে নিহতের ছোট ভাই সাহেল আহমদ বলেন, ‘রোববার রাতে পুলিশ অফিসার সিরাজ আমারে ডেকে থানায় নেন। সেখানে একটি সাদা কাগজে সই (স্বাক্ষর) রাখেন। পরদিন সন্ধ্যায় আম্মারে লইয়া থানার ওসি’র রুমে গেছি আমার বোনকে হত্যা করা হয়েছে মামলা দিতে। কিন্তু ওসি সাব ময়নাতদন্ত রিপোর্ট না পেলে হত্যা মামলা হয় না, ই কথা কইয়া আমাদেরকে বিদায় করে দেন।’
বিয়ানীবাজার থানার এসআই সিরাজুল ইসলাম সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘রিমা বেগম নিজে নিজে ওড়না প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এমন কথা কাগজে লেখা ছিল। তা পড়েই সাহেল আহমদ স্বাক্ষর করেছেন।’ তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্টের উপর নির্ভর করবে এটি আত্মহত্যা, না হত্যা। এ মুহূর্তে এরচেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
নিহত রিমা বেগমের শ্বশুর ফলিক মিয়া বলেন, ‘রিমার হাতে দেয়া ভাত খাইয়া সকাল ১০টায় বাইরে বের হইছি। দুপুর ১২টায় ঘরে ফিরে দেখলাম আমার স্ত্রী ঘুমে। রান্নাঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাইরের জানালা দিয়ে দেখি রিমা ফাঁস লাগছে। তখন আমি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাই।’ ভাগ্নে নুরুল হক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি কোন কথারই সদুত্তর দিতে পারেননি। জামাতা হোসেন আহমদ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রিমার সাথে হোসেনের যা হয়েছে তা আমি অবগত নই। রমজানে মীমাংসার বিষয়টিও আমার জানা নেই।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ জানেন রিমা নিজে মরছে না অন্য কেউ মারছে। আমি আইয়া পাইছি বর্গার সাথে ঝুলাইল।’
রিমা বেগমের ঝুলন্ত দেহ মাটিতে নামিয়েছেন ভাগ্নে নুরুল হক। সাংবাদিক পরিচয়ে এ বিষয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে তাঁর সাথে ফোনে কথা হলে তিনি রহস্যজনক আচরণ করেন। কোনো কথার সদুত্তর না দিয়ে, গাড়ি নিয়ে কুমিল্লায় ব্যস্ত আছেন, ৫ মিনিট পর কল করার কথা বলে লাইন কেটে দেন। এরপর থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে রিং হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নিহত রিমার ননদ জামাই হোসেন আহমদের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা জানা যায়নি।
নিহত রিমা বেগমের মা জয়নব বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে হোসেনসহ তারা হত্যা করে ফাঁসির নাটক সাজিয়েছে। তিনি হত্যাকারীদের ফাঁসি চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।’
এ বিষয়ে বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ অবণী শংকর কর বলেন, ‘হত্যা মামলা নেইনি এ কথা সঠিক নয়। নিহতের মা ও ভাই আমার কাছে এলে আমি ময়নাতদন্ত রিপোর্টে যা আসবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি। এর আগে নিহতের ভাই অপমৃত্যু কাগজে স্বাক্ষর করেছে এবং ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুরোধ করে। কিন্তু, আমি তাদের কথায় রাজি না হয়ে পোস্টমর্টেম করিয়েছি। তিনি আরও বলেন, হত্যা না হয়ে যদি এটি প্ররোচিত আত্মহত্যা হয়, তাহলেও পরিবার চাইলে আমরা মামলা নেব।
প্রতিবেদনটি আজ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে