বেসরকারি (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা) শিক্ষকদের দু:খ-দুর্দশা মোচন করবে কে?
বিয়ানীবাজার বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০১৯, ১:৪৬ পূর্বাহ্ণ।। আতাউর রহমান।।
শিক্ষকতা এক মহান পেশা। এ দুনিয়ায় এমন সম্মানী পেশা দ্বিতীয়টি আর নেই। সবাই বলেন, শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার দক্ষ কারিগর। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সততা, দেশপ্রেম, দক্ষতা ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা সম্পাদন করে থাকেন এই সম্মানিত শিক্ষকরা। কিন্তু শিক্ষক কর্তৃক সৃষ্ট জনসম্পদ দেশ চালনার দায়িত্ব পেলেও শিক্ষকদের দু:খ-দুর্দশার জীবনযাপনের পরিণতি গেল ৪৮ বছরেও সমাধান হয়নি। এ যেন চলছে লক্ষ্যহীন যাত্রাপথ!
অন্যরূপে, সমাজের মানুষ শিক্ষকদের সালাম দেয়, স্যার বলে, কেউ কেউ আবার মাস্টার সাব বলে সম্মান দেন। আর বলেন যে, মাস্টার সাব, আপনাদের এতো টাকার দরকার কি? আপনারা প্রতিদিন যে পরিমাণ সালাম পান তাতে আপনাদের দু:খ-দুর্দশা শোনার কী বা দরকার!
আমরা সবাই জানি, জাতির উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। মানুষের প্রধান মৌলিক অধিকার শিক্ষা নামক উপাদান-ই হচ্ছে জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ছাড়া দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষাধিকার অর্জিত হলে অন্যান্য অধিকার প্রাপ্তির পথ সুগম হয়। অথচ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আমাদের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষাকে মৌলিক নীতিমালা হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এগুলো সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দিক নির্দেশনা দেয়।
এদিকে বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারী উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তাঁরা সর্বদাই বঞ্চিত হন। যেমন :
© বেসরকারি শিক্ষকরা—–
(ক) মাসিক বাড়িভাড়া পান ১০০০ টাকা। এই টাকায় কোন বাড়ির বারান্দা ভাড়া পাওয়া যাবে কি-না কে জানে।
(খ) মাসিক চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। কি নির্মম পরিহাস! শুনতেও লজ্জা লাগে।
(গ) উৎসব ভাতা পান স্ব-স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। তা নিতান্তই অপ্রতুল ও হাস্যকর;
(ঘ) কোনো শিক্ষাভাতা, টিফিনভাতা এবং পাহাড়িভাতা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) পান না।
(ঙ) বেসরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতির কোনো সুষ্ঠু বিধি ব্যবস্থাও নেই।
পাশাপাশি আমাদের স্বাধীন দেশে একই শিক্ষাব্যবস্থা, একই শিক্ষাক্রম, একই পাঠ্যসূচির আওতায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করানো হয়। একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। আর তাতে দেখা যায় বরাবরই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাল ফলাফল করে। আরো লক্ষণীয় যে, দেশের শতকরা ৮৬% শিক্ষার্থীরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। পক্ষান্তরে, বেতন-ভাতাদি প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ পান উচ্চস্কেলের বেতন ভাতাদি আর বেসরকারি শিক্ষকরা পান নিম্নস্কেলের বেতন ভাতাদি। একই শিক্ষাব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন চিত্রের বৈষম্য খুবই কষ্টদায়ক। পৃথিবীর অন্য কোনো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এমন তুঘলকি প্রথা আছে বলে কারো জানা নেই।
এমতাবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণ ও দেশের মেধাবীদের এই পেশায় আনার জন্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের জন্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাঁর এই ঘোষণা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেল; কখনো আর আলোর মুখ দেখল না। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা আমাদের দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
স্বাধীন দেশের একজন শিক্ষক তার নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরনপোষণ করতে যকগন ব্যর্থ হয় তখন তিনি এই মহান পেশা ছেড়ে জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হন। তাই মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার দিকটা নিশ্চিত করা উচিৎ। যদি তাই হয়, তবেই দেশে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে এবং যোগ্য নাগরিক তৈরির পথ প্রশস্ত হবে।
কোনো জাতি যদি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় তাহলে সে-জাতির পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬.৬ শতাংশ বিনিয়োগ করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী শিক্ষাখাতের ব্যয় ৬.৬% হওয়া উচিত। সারাবিশ্বে যখন শিক্ষা বাজেট বাড়ছে আমাদের দেশে তার চিত্র উল্টোদিকে।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নিজে প্রায়ই বলতেন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ একমাত্র শিক্ষাই পারে দেশকে পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করতে। তিনি আরো বলতেন, “আমরা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারি না”। তাহলে কিভাবে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হবে?
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গপিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা,’ডটার অব পিস’ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জাতির দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ও লক্ষ্যের প্রতিফলন সম্বলিত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয়। কিন্তু একই সরকার কেন তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারছে না? এটা গুরুত্ব দিয়ে দেখার বিষয়। শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষাখাতে অধিকতর বাজেট বরাদ্দ ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
ভাবনার বিষয়, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শিক্ষকদের দু:খ-দুর্দশা মোচন করবে কে? বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এনং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিতে হলে শিক্ষক সমাজের ন্যায্য পাওনা (যেমন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায় পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, টিফিনভাতা, পাহাড়িভাতা, শিক্ষাভাতা) দেওয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। এদেশের শিক্ষকসম্প্রদায় তাঁদের ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের দাবী করতেই পারে সরকার বাহাদুরের কাছে। আর করাটাই স্বাভাবিক।
#লেখক: সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, সিলেট। সভাপতি- বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।